‘টেকনাফ নিউজ ডটকম::এলোরে দেখ ঐ মাহে রমজান/জাগোরে মুসলমান’ কিংবা ‘আমরা কাসিদাওয়ালা যাই ডেকে যাই/ ওঠো ওঠো মমিন সেহরির সময় নাই।’
পবিত্র রমজান মাসে রাতে সেহরি খাওয়ার জন্য রোজাদারদের জাগানোর উদ্দেশে এভাবেই পরিবেশিত হতো শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কাসিদা।
কাসিদা প্রথা শতবছর আগে থেকেই মিশে রয়েছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যে। কালক্রমে এই প্রথা আজ বিলুপ্তির পথে। আগের মতো আয়োজন না থাকলেও, পুরান ঢাকার মানুষ এখনও ধরে রেখেছেন সে ঐতিহ্য। একদল তরুণ এখনও গান গেয়ে রোজাদারদের ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। তবে সে ডাক আগের মতো পৌঁছায় না রোজাদারদের কানে।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী বজলুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘পনের/বিশ বছর আগেও রমজানের রাতে পুরান ঢাকায় এক ধরনের উৎসবের আমেজ থাকতো। ছেলে-বুড়ো বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে অলিতে গলিতে রোজাদারদের জাগিয়ে তুলতো। এখন সেরকম চিত্র তেমন দেখা যায় না।’’
কাসিদা শব্দটি ফার্সি। শাব্দিক অর্থ-কবিতার ছন্দে প্রিয়জনের প্রশংসা করা। মূল আরবি শব্দ ‘ক্বাসাদ’ বিবর্তিত হয়ে কাসিদা শব্দে রূপ নেয়।
প্রাচীন ঢাকার ওপর লিখিত কয়েকটি ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, মোঘলদের হাত ধরে ঢাকায় কাসিদার আগমন। তখন ফার্সিতে লেখা হতো কাসিদা। কারণ তখন ফার্সিই ছিল মোঘলদের দরবারি ও প্রশাসনিক ভাষা। নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখতেই এ ভাষার চর্চা করতেন মোঘলরা। পূর্ববঙ্গে কাসিদার প্রাচীনতম তথ্যটি পাওয়া যায় মোঘল সেনাপতি মির্জা নাথানের ‘বাহারিসত্মান-ই-গায়বি’তে। মির্জা নাথানের বর্ণনানুসারে বলা যায়, কোনো বিষয়ের প্রশংসা করে রচিত হতো কাসিদা। বিশেষ বিশেষ উৎসবকে আরও বর্ণময় করে তোলার জন্যই লেখা হতো কাসিদা। প্রাক- ইসলাম যুগেও আরবি সাহিত্যে কাসিদার চর্চার কথা উল্লেখ রয়েছে। মাহে রমজান, ঈদ-উল-ফিতর ও মহররম উপলক্ষে মূলত কাসিদা রচনা করা হয়। আর এ অঞ্চলে এসব বেশি করতেন ঢাকার আদি অধিবাসীরা। এই ঢাকাবাসীরা আবার দু`ভাগে বিভক্ত। এক দলে ছিল ‘সুব্বাসী’ বা ‘সুখবাসী’। তারা নিজেদের মধ্যে খুব করে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা করতেন। ঢাকার মোঘল ঘরানার শেষ ধারক বাহক ছিলেন এই সুব্বাসীরা। নিজেদের মধ্যে তারা উর্দু বা ফার্সি চর্চা করতেন। আদি অধিবাসীর আরেকটি দল হচ্ছে ‘কুট্টি’। বাংলার সঙ্গে উর্দু ও হিন্দি শব্দ মিশিয়ে কথা বলতেন এরা। তাদের কাসিদার ভাষাও উর্দু ও ফার্সি।
ঢাকায় কাসিদার প্রচলন কবে থেকে শুরু হয়েছিল তার প্রমাণিত কোনো তথ্য নেই। তবে মোঘল আমল থেকে এর প্রচলন বলে অনুমান করা হয়।
সায়লা পারভীনের লেখা ‘হারিয়ে যাওয়া কাসিদা’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, পুরনো ঢাকার উর্দু রোড, কসাইটুলী, বকশীবাজার, হোসেনী দালান ও বংশালে কাসিদা জনপ্রিয় ছিল।
দলবদ্ধ হয়ে পাড়া-মহল্লায় রাতের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে যুবকরা হ্যাজাক লাইট আর লাঠি নিয়ে কাসিদা পরিবেশন করেন।
প্রযুক্তির যুগে এখন কাসিদা গেয়ে রোজাদারদের জাগিয়ে তুলতে হয় না। সেলফোনের অ্যালার্মেই রোজাদাররা সেহরি খেতে ওঠেন। তবুও ঐতিহ্য ধরে রাখতে পুরান ঢাকায় একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি কাসিদা প্রথা। এখনও একদল তরুণ খালি গলায় গেয়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এ কাসিদার ঐতিহ্যকে আকড়ে ধরে রাখতে চান।