আতিক মাহবুব …মাটির দেয়াল, বাঁশ বেতের মোড়া দিয়ে তৈরি জানালার ফাঁক-ফোকর ভেঙে ভোরের কুয়াশার চাদর ঝেড়ে লাল সূর্যটা ঠিকরে পড়েছে প্রেমিকার চোখে। কৃষ্ণচূড়ার লালাগু বুকে লালন করে সে যেন হয়েছে চিত্রমোহনী। মুহূর্তেই প্রকৃতির সাথে মিশে একাকার। ইটখোলা জীবনকে পাশ কাটিয়ে কোন এক দিগন্তে প্লাবিত গাঁয়ে কুয়াশা ঘেরা সবুজ মেঠো পথে হাটতে গিয়ে থমকে গেল অহনা। সবুজ ঘাসে নগ্ন পা ডুবিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে দৌড়ে যাবে সে খোলা আকাশের নিচে। গাছের পাতা আর ছিটকে পড়া ডালপালার আবরণে দুজনে হারিয়ে যাবে কোলাহল থেকে। এভাবে পুকুর জলের মত শান্ত মনে প্রতিনিয়তই স্বপ্নের জাল বুনে সে। তাঁর প্রেমিক জাকির কাজ করে অনেক দূরে, হেঁটে দু’দিনে পথ। সময় আর প্রয়োজনের কাছে হার মানে অসীম ভালবাসা। আবার জাকির যা আয় করে তাতে প্রতিদিন গ্রামে আসাই অসম্ভব। তবে আলাপনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে অযুত দূরত্ব মুহূর্তে মুঠোয় পুরতে হাড়-মাংসের উপার্জনের টাকা দিয়ে নিজের জন্য না কিনে অহনার জন্য কিনে একটি মোবাইল ফোন। অহনার হাতে মোবাইল পৌঁছলো। বেশ কিছুদিন তাদের আলাপচারিতাও হয়। অপেক্ষা নামক দীর্ঘ বিরহখরা থেকে একটু প্রশান্তি পায় দু’চারটে আলাপে।
তবে এ আলাপ স্থায়িত্ব বেশিদিন টিকেনা, কারণ দুজনার আলাপ হয় কখনো সপ্তাহ কিংবা মাসে একবার, ফলে দূরত্বই আগের মতই। জাকির কাজ নিয়ে মগ্ন থাকে সারাদিন আর বেচারি অহনা ছয়-নয় ও আকাশ- কুসুম চিন্তায় বিভোর হয়। আকাশে বাতাসে কবিতা লেখে, কোকিলের কুজনে সুর মেলায়, শূন্যতা অংকিত করে দীঘির জলে। ধীরে ধীরে জাকিরের দেয়া মোবাইলের প্রতি তাঁর ক্ষোভ জন্মে, ইচ্ছে করে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে, সাগরের সফেদ ফেনায় ডুবিয়ে মারতে। প্রকৃতিকণ্যা আস্তে আস্তে মোবাইলের ভিতরটা দেখতে উৎসুক হয়, জাকির যে নাম্বারগুলো থেকে ফোন দিত সেগুলোতে এক, দুই, তিন করে এভাবে বিভিন্ন নাম্বারে মিসড কল দেয়, তবে সাড়া আসেনা, রাগে সিংহের মত অগ্নিমূর্তি ধারণ করে।
সায়ংসময় থেকে রাত আরো গভীরতায় মজে, হঠাৎ মোবাইল ফোন বেঁজে উঠে, একবার নয়, বহুবার, তবে অহনা রিসিভ করে নি। অনেকদিন ধরে ফোন নেই, আর উনার সাধ হয়েছে ‘গভীর রাতে ফোন কোলে নিয়ে হাপ্পিটিস করতে’ (?)
মোবাইল বাজে সকাল পর্যন্ত তবে অহনা সেই আগের মত নাছোড়বান্দা, বাজুক শতবার প্রতিশোধ!
সকাল থেকে দুপুর, তারপর বিকেল গড়ায়, তবে আর কোনো কল আসে না, বেচারা কোন কারণে কল দিল জানা হলো না, হয়ত অনেক দিনের জমানো কথা বলতে চেয়েছিল, কিংবা তাঁর জন্য জামদানি শাঁড়ি, কোঁমরের বিছা, হাতে চুড়ি কিনে আনবে কি না? না কিছুই জানা হলো তাঁর, ভেবেছিল রাগ কমে যাবে জাকিরের, আবার হয়ত রাতে কল দিবে। তবে অপেক্ষার প্রহরে তাঁর ‘চোখের জল সবিতায় জ্বেলে উঠে’, কল তো আর আসে না। খাওয়া নেই দাওয়া নেই, অহনার চেহারায় আফ্রিকায় দূর্ভিক্ষগ্রস্থ মানুষের ছাপ ফুটে ওঠে।
হঠাৎ একদিন অজ্ঞাত নাম্বার থেকে কল, ফোন বাজতেই রিসিভ, শুরু হলো অহনার ক্ষমা চাওয়া, অভিমান ভাঙানোর কথামালা, ভালবাসার জন্য মনের ভেতর যে আকুলতা তা ফুটে তোলার চেষ্টায় ব্যস্ততা। তবে অপারে এক অপরিচিত ভদ্র লোকের স্বর শুনা গেল, অহনার শ্রাবণ ভেজা ও দরদমাখা কন্ঠে নিজেকে চিন্তার সাগরে নিমজ্জন করলো লোকটা। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শুরু করলো এটা তার ‘ভূল ডায়াল’, তবে জাকিরের বিরহতাহে ক্ষতবিক্ষত অহনা তাকে অপরিচিত মানতে নারাজ, তুমিই জাকির, আমার সাথে আর হেয়ালি করো না….।
অপরিচিত লোকটার নাম রাসেল, তার আর জাকিরের কন্ঠ অভিনব ও হুবহু! সে অহনার সাথে আবার কথা বলে, সুযোগে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, ধীরে ধীরে মনের মধ্যে এক অভিন্ন টান অনুভব করে।
প্রকৃতির সাথে প্রেমের নিবিড় সম্পর্কে পরিবর্তন এসেছে। যুগের চাহিদায় সব কিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধীরে ধীরে অহনার ভালবাসা প্রকাশের ধরণেও পরিবর্তন ঘটেছে।
রাতের পর রাত মোবাইলে তারা একে-অন্যকে সিক্ত করে। সবাই যখন ঘুমিয়ে, তাঁরা তখন ব্যস্ত মোবাইল নেটওয়ার্কে।
অহনার মত গ্রামের সবুজ অবোধ তরুণী মোবাইলের মেমোরীতে জমে থাকা ভাইরাসের মত আস্তে আস্তে জাকিরের মত সরল-সহজ মানবের প্রতিকৃতি মন থেকে মুছে ফেলছে।
এখন এক অজানা আহবানে মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে রাসেলের সর্বাধিক প্রিয় শব্দটি শুনার জন্য, তাঁর হৃদয় ব্যাকুলতায় ছলছল করে। আর রাসেলও বইয়ের পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেওয়া গোলাপের পাঁপড়ির বদলে মোবাইল ফোনে ভালবাসায় সিক্ত, উদাসী আবেগী মনকে বড় কাছে টেনে আনে। একে অন্যকে না দেখে এগিয়েছে অনেক দূর।
তরুণী অহনা ইতোমধ্যে রাসেলের সাথে দেখা করেছে, একটু একটু করে জমা ভাললাগা রূপ নিয়েছে গভীর ভালবাসায়। তার মায়াবী চোখ দুটি প্রেমিককে ভাসিয়েছে অথৈয় সাগরে। চোখের ভাসায় ভাব বিনিময়ের সেই পুরোনো রেওয়াজে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। যেখানে ভালবাসায় প্রকৃতির বদলে যোগ হয়েছে প্রযুক্তি। তাইতো অহনার চোখে যুক্ত হয়েছে অচেনা ছেলেটিকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন।
Leave a Reply