উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে টেকনাফ উপকূল দিয়ে ট্রলারযোগে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর অনাহারে অর্ধাহারে থাকা লোকজনকে বস্তাবন্দী করে সাগরে ফেলে দেয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে। এছাড়া ৮৫ হতভাগ্যদের আরো টাকার জন্য থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতনের আর্তনাদ মোবাইল ফোনের মাধ্যেমে শোনানো হচ্ছে স্বজনদের।
বিগত সময়ে দালাল চক্র টেকনাফের উপকূল টেকনাফ, উখিয়া, কোটবাজার, রামু, কক্সবাজার চরপাড়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোরসহ বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য লোকজনকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার নামে প্রতারণার মহা ফাঁদ তৈরি করে। এতে অনেকে সাগরে মৃত্যু, অনাহারে-অর্ধাহারে বনে বন্দি ও জেলজীবন, আবার অনেকে নিজের স্ত্রী ও মা-বোনের স্বর্ণের গহনা বিক্রি করে সর্বশান্ত হচ্ছেন।
এদিকে, দালালদের নৃশংসতা নিয়ে চলছে হতভাগ্যদের পরিবার ও স্থানীয় জনমনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। মালয়েশিয়া আদম পাচারকারী দালালদের শনাক্ত করে কঠিন শাস্তির পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছে সুশীল সমাজ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বর্ষায় প্রতিকূল অবস্থাতেও টেকনাফে আদম পাচারকারী চক্র সমুদ্র পথে বিভিন্ন দরিদ্র ও বেকার লোকজনকে কম মূল্যে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ১৫ জুলাই রাতে টেকনাফের উপকূল দিয়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা ছাড়াও হোয়াইক্যং, উনচিপ্রাং, লম্বাবিল, রইক্ষযং, কুতুবদিয়াপাড়া এলাকার ৩০/৩৫ বাসিন্দাসহ ৯০ জনকে নিয়ে একটি ট্রলার মালয়েশিয়া অভিমুখে রওয়ানা করে।
ট্রলারটি মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশের সমুদ্র উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে এবং গভীর সমুদ্রে একাধিকবার ইঞ্জিন বিকল হয়ে সাগরে দিক-বিদিক ভাসতে থাকে। দীর্ঘ ৮/১০দিন সাগরের ভাসতে থাকায় ওই ট্রলারে অধিকাংশ লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে দুই রোহিঙ্গাকে ক্ষুধায় কাতর অবস্থায় ট্রলারে থাকা দালাল চক্রের লোকজন বস্তাবন্দী করে সাগরে নিক্ষেপ করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ট্রলারে থাকা দালাল চক্রের সঙ্গে মালেশিয়াগামীদের দুই দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
দালার চক্র জনপ্রতি এক লাখ ৯০ হাজার টাকা চুক্তি করে চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজযোগে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও টেকনাফের সাবরাং উপকূল দিয়ে একটি ট্রলারে করে মালয়েশিয়া রওয়ানা দেয়ায় আপত্তি তুললে হোয়াইক্যংয়ের রইক্ষং এলাকার আব্দুল জব্বার নামে এক মালয়েশিয়াগামীকে বেধড়ক পিটিয়ে বস্তাবন্দী করে সাগরে ফেলে দিতে চাইলে তার সঙ্গের লোকজন ও দালাল চক্রের সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে।
অবশেষে ট্রলারটি ক্ষুধায় অসুস্থ মালয়েশিয়াগামীদের নিয়ে প্রায় ১২ দিন পর থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছে। সে দেশে অবস্থান করা দালাল চক্রের লোকজন এই হতভাগ্যদের গভীর বনে নিয়ে বন্দি করে রাখে। তাদের থাইল্যান্ড থেকে যানবাহনে করে চোরাই পথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু চুক্তির টাকা না দেয়ায় শতাধিক হত-দরিদ্র লোককে এখনো গভীর বনে বন্দি রেখে ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। এই নির্যাতনের কথা মোবাইল ফোনে পরিবারে জানিয়েছে হোয়াইক্যং, উনছিপ্রাংসহ বিভিন্ন এলাকার হতভাগ্য লোকজন।
এ দিকে নির্যাতনের শিকার ও নিখোঁজদের পরিবারে শোকের মাতম উঠেছে। মালয়েশিয়া যাত্রাকালে বিভিন্ন দেশে আটক ও সাগরে মৃত্যুর খবরে এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
অপরদিকে ৮ মে টেকনাফের সাবরাং উপকূলীয় এলাকা দিয়ে একটি ট্রলারে করে শতাধিক লোক মালয়েশিয়া যাত্রা করে। তাদের মধ্যে সাগরে দুর্ঘটনায় অনেকের মৃত্যু ও মিয়ানমার কারাগারে আটকের খবরে স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেছে।
এ ট্রলারে হোয়াইক্যংয়ের কুতুবদিয়াপাড়া এলাকার আব্দুর রহিমের ছেলে আবছার, ধলা মিয়ার ছেলে সরওয়ার, আব্দুস শুক্কুরের ছেলে হারুন, সফু মিয়ার ছেলে আজিজুল হক, আবু তালেকের ছেলে মো. রফিক, কবির আহমদের ছেলে আনিসুর রহমান, নুরুল আলমের ছেলে সোনা মিয়া, নুর আহমদের ছেলে জসিম, উনচিপ্রাং এলাকার অমির হামজার ছেলে আব্দুল করিম, আব্দুর রহমানের ছেলে শাহ আলম, রইক্ষং এলাকার কালু মিয়ার ছেলে আবু ছিদ্দিক, উখিয়ার পালংখালী এলাকার মোহাম্মদের ছেলে নুরুল কবির, লেদা রোহিঙ্গা বস্তি এলাকার রহমত উল্লাহ, নজির আহমদসহ ১২০ জনকে ভর্তি করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।
বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাগর উত্তাল হয়ে উঠায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সাগরপথে আদম পাচার বন্ধ রয়েছে বলে ধরে নেয়। কিন্তু নিষ্ঠুর লোভী-নাছোড়বান্দা দালালেরা কি আর সুযোগ হাতছাড়া করে। সম্প্রতি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ইন্ধনে সৃষ্ট সহিংসতায় নির্যাতনে অতিষ্ঠ মুসলিম যুবকেরা সহায়-সম্বল বিক্রি করে প্রাণে বাঁচার জন্য মালয়েশিয়া পালাতে গিয়েই এসব দালালের খপ্পরে পড়ে।
বেকার যুবকদের কম দামে মালয়েশিয়া নেয়ার নামে মানবতাবিরোধী নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়কারীরাসহ আদম পাচারকারী চিহ্নিত দালালদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করতে হবে বলে সর্বস্তরের মানুষ মনে করেন।
Leave a Reply