ব্যক্তিগত ঘটনা দিয়ে লেখাটি শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে এক বছর স্যাবাটিক্যাল ছুটি নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে খুলনার নতুন ভাড়া বাসায় সেটেল করার পর শুরু হয় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা যেতে থাকেন। বাংলাদেশেও করোনাভীতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি সপরিবারে গৃহবন্দি হয়ে পড়ি। অন্য দেশগুলোর মতো একপর্যায়ে বাংলাদেশেও শুরু হয় ‘শাটডাউন’ এবং ‘লকডাউন’। আমরা সর্বক্ষণ ঘরে থাকি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি; কিন্তু অনেকে এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় মনোবল হারিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগেছেন। এমন অবস্থা করোনা রোধের জন্য প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। আমি ভাবি, ঘরে বসে কেমন করে সময় কাটাব? মন ভালো না থাকায় পড়তে ভালো লাগে না। কিছু লেখালেখির চেষ্টা করি। এমন সময় আমার স্কুলবন্ধুদের ‘স্কুলফ্রেন্ডস’ নামের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের খবর পাই। আমাকে ওই গ্রুপে যোগ দিতে বললে স্কুলবন্ধুদের দেখতে উদগ্রীব হয়ে সানন্দে ‘স্কুলফ্রেন্ডস’-এ যোগদান করি।
এ গ্রুপে যোগ দিয়ে বহু বছর পর অনেক বন্ধুর ছবি দেখে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে আনন্দে আপ্লুত হই। অন্য সবার মতো গ্রুপে মাঝেমধ্যে ছবি ও স্ট্যাটাস দিই। এ গ্রুপে সময় কাটিয়ে প্রথমদিকে বেশ আনন্দ পাই। কিন্তু কয়েকদিন পর লক্ষ করি, এদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইয়ার্কি-ফাজলামি করা, ফান করা, যৌন রসাত্মক গল্প বিনিময় করা, ঝগড়াঝাঁটি করা এবং দুষ্টুমি করে পরস্পরকে গালি দেওয়া। আর খেলা থাকলে সে খেলা দেখা এবং সে সম্পর্কে মতামত বিনিময় করা। অবশ্য কোনো বন্ধু অসুস্থ হলে তার জন্য এরা ভার্চুয়াল দোয়া পরিচালনা করে। অসুস্থ বন্ধুকে পরামর্শ দেয় এবং দেখভাল করে। গরিব সহপাঠীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, যা প্রশংসনীয়। কিন্তু সুশিক্ষিত নাগরিক হয়েও এরা দেশজ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে না। বিশেষ করে স্বদেশি রাজনীতিতে এদের মারাত্মক অ্যালার্জি, যদিও বিদেশি রাজনীতি নিয়ে তাদের কেউ কেউ দু-একবার আলোচনা করে।
আমি বিপন্ন বোধকরি। কারণ, প্রায় ৪০ বছর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি পড়াই। সমসাময়িক স্বদেশি রাজনীতির ওপর পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখি। করোনাকেন্দ্রিক প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, করোনা পরীক্ষা না করে ভুয়া সনদপত্র বিক্রয় ব্যাবসা, ক্যাসিনোকাণ্ড, গণতন্ত্রহীনতা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও আর্থিক দুর্নীতি বিষয়ে পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হলেও বন্ধুদের গ্রুপে আমি সেসব শেয়ার করিনি। কারণ, সরকার বা প্রশাসনের সমালোচনা করতে বা শুনতে বন্ধুদের অনীহার বিষয়টি আমি বুঝতে পারি। এক পর্যায়ে বলি, আমি যদি আমার মতামত বন্ধুদের সঙ্গেই শেয়ার করতে না পারি, তাহলে আর কার সঙ্গে শেয়ার করব? আরও বলি, তোমরা যদি নীতিমালা পাস করে গ্রুপে রাজনৈতিক স্ট্যাটাস দেওয়া নিষিদ্ধ কর, তাহলে আমি তোমাদের সিদ্ধান্ত মেনে চলব। একপর্যায়ে তারা সে রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে আমি গ্রুপে স্ট্যাটাস দেওয়া থেকে বিরত থাকি। আমার প্রিয় বন্ধুরা সব উচ্চশিক্ষিত। দেশ-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। কেউ নামকরা ডাক্তার, প্রকৌশলী, চাকরিজীবী, আবার অনেকে অবসরপ্রাপ্ত। কেউ কানাডাপ্রবাসী ব্যবসায়ী, কেউ সিঙ্গপুরপ্রবাসী ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ার এবং আরও বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী পেশাজীবী। এদের সাফল্যের কথা ভাবলেও মনটা ভালো লাগে।
কিছুদিন পর এক বন্ধু সাক্ষাতে আমাকে জিজ্ঞেস করে, দোস্ত তুমি কি গ্রুপ পরিত্যাগ করেছ? গ্রুপে কোনো স্ট্যাটাস দাও না কেন? আমি তাকে সবিনয়ে বলি: দ্যাখ, তোমরা আমার স্কুলবন্ধু। এত বছর পর একটি প্লাটফরমে তোমাদের সন্ধান পেয়েছি। আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে পারি না। তবে আমি তো ওয়াদা খেলাপকারী হতে পারি না। তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছ, গ্রুপে রাজনৈতিক পোস্ট দেওয়া যাবে না। সে কারণে লিখি না। কারণ, রাজনীতির শিক্ষক হিসাবে আমি লিখলে আমার লেখায় রাজনীতি আসবে। আমি তো তোমাদের সিদ্ধান্ত অমান্য করতে পারি না। তবে গ্রুপে না লিখলেও আমি সব সময় তোমাদের কল্যাণ কামনা করি। তোমাদের সঙ্গে তর্কে জড়াতে চাই না। যে রাজনীতি করে দেশ পেলাম, ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করলাম, স্বাধীনতা পেলাম, সে রাজনীতিকে ছাড়তে পারব না। তোমরা রাজনীতিকে কেন ভয় পাও, আমি বুঝতে পারি না। রাজনীতিকে ভয় পেলে সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করবে কী করে? সুস্থ রাজনীতি তো মানুষের কল্যাণের জন্য। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। চোর-চোট্টা, বদমাশ, মুনাফাখোর, কালোবাজারি, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজরা রাজনীতিকে ভয় পেতে পারে। তোমরা ভয় পাবে কেন? তোমাদের মতো শিক্ষিত ও সচেতনরা যদি রাজনীতি থেকে দূরে থাক, তাহলে রাজনীতি কীভাবে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত ও গণমুখী হবে? বন্ধু আমার কথার উত্তর দেয়নি।
এ ব্যক্তিগত উদাহরণ থেকে অনুধাবন করা যায়, এখন শিক্ষিত, সচেতন, ভালো মানুষ রাজনীতিতে জড়াতে চান না। তারা রাজনীতি থেকে দূরে থাকা নিরাপদ মনে করেন। তারা একবারও ভাবেন না, শিক্ষিত ও ভালো মানুষ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেলে অসৎ, ব্যবসায়ী, মুনাফালোভী ব্যক্তিরা রাজনীতিতে স্থান করে নেবেন। আর তারা রাজনীতিকে কলুষিত করার মধ্যদিয়ে নিজেদের আখের গোছাবেন। গদি, পদ এবং অর্থলোভী ব্যক্তিরা যদি রাজনীতির চালকের আসনে বসেন, তাহলে তো তারা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে জনকল্যাণে ব্যবহার করবেন না; পরিবর্তে অনেকেই রাজনীতিকে ব্যাবসা হিসাবে গ্রহণ করে ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়বেন। নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য অন্যায় করতে তিনি দ্বিধা করবেন না। চাঁদাবাজি, গ্রেফতার বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্য, রাজনৈতিক পদ কেনাবেচা, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, মানি লন্ডারিং, নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ারিংসহ কোনো কিছু করতে অসৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব পিছপা হবে না।
আগে মনে করা হতো সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণের পর সুস্থ রাজনীতিকে ভয় পায়। কারণ, জনসমর্থন না থাকায় তারা দেশের মানুষকে রাজনীতিবিমুখ করতে চাইতেন। তারা বিরাজনীতিকরণের জন্য বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু এখন বিশ্বব্যাপী সামরিক একনায়কতন্ত্র হ্রাস পেয়েছে। তবে অনেক দেশে বেসামরিক লেবাসে তথাকথিত গণতন্ত্রের মুখোশপরা স্বৈরশাসন চলছে। এ কথা ভুলে না যাওয়া ভালো, সরকার বেসামরিক বা নির্বাচিত হলেই সেই সরকার গণতান্ত্রিক সরকার হবে এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কোনো সরকার বেসরকারি এবং নির্বাচিত হয়েও স্বৈরতান্ত্রিক হতে পারে।
প্রায় সোয়া দুই দশক আগে এমন স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকেই ফরীদ জাকারিয়া তার বহুলপঠিত প্রবন্ধ ‘দ্য রাইজ অব ইললিবারেল ডেমোক্র্যাসি’ শীর্ষক প্রবন্ধে শালীন ভাষায় ‘অনুদার গণতন্ত্র’ বলেছেন। এমন গণতান্ত্রিক সরকার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। এ গণতন্ত্রে দুর্নীতি প্রাধান্য পায়। সভা-সমাবেশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। রাজনৈতিক বিরোধিতার ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয়। স্বৈরতন্ত্রের অন্য আরও অনেক বৈশিষ্ট্য এমন সরকার ধারণ করে নিজেদের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার দাবি করে।
এমন তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার সব সময় সুস্থ রাজনীতিকে ভয় পায়। কারণ, তারা জানে, অগণতান্ত্রিক ও নিপীড়নমূলক কাজের জন্য তারা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সে কারণে তারা জনগণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে। হামলা-মামলায় জর্জরিত করে। অনেক ক্ষেত্রে জনমতকে তোয়াক্কা না করে নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ারিং করে তারা ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেষ্টা করে। এ চেষ্টায় সফল হওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পক্ষে রাখে। সুযোগ-সুবিধা ও পদ-পদবি দিয়ে এমন সরকার সুশীল সমাজের সদস্য ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশকে ক্রয় করে। আর চেষ্টা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজনীতিকরণের আবহ তৈরি করতে। সাধারণ মানুষ সব বুঝলেও অনেক ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকেন। যোগ্য, শিক্ষিত ও সচেতনরা রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে নিজেদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এভাবে ভালো মানুষ রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ায় দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঘটে। এমন অজনপ্রিয় রাজনীতিবিদরাই সুস্থ রাজনীতিকে ভয় পান।
আমার হোয়াটসঅ্যাপের ‘স্কুলফ্রেন্ডস’ গ্রুপের উচ্চশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত স্কুলবন্ধুদের রাজনীতির প্রতি যুগপৎ অ্যালার্জি ও ভীতি দেখে আমি বিস্মিত হই। ভাবি, এদের মতো উচ্চশিক্ষিত নাগরিকরাই যখন রাজনীতিকে এতটা এড়িয়ে চলতে চান, তাহলে সাধারণ মানুষ তো রাজনীতিবিমুখ হবেনই। আর একটি দেশের অধিকাংশ মানুষকে যদি বেসামরিক তথাকথিত অনুদার গণতান্ত্রিক সরকার রাজনীতিবিমুখ করতে পারে, তাহলে তাদের ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘ করতে সুবিধা হয়। প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসাবে সারা জীবন সরকারি চাকরি করে ঘুস খেয়ে টাকা বানিয়ে অবসরগ্রহণের পর হজ করে ধার্মিক লেবাস ধারণ করে এক শ্রেণির লোক যেমন নীতিবাক্য আওড়ান, আমার প্রিয় স্কুলবন্ধুদের আমি তেমন ভাবি না। ভাবতে চাই না যে, তারাও যৌবনে রাজনীতি করে অনেক অবৈধ ফায়দা লুটে এখন রাজনীতিবিমুখ হয়েছেন। তবে তা না হলে সচেতন ব্যক্তি হয়েও বাল্যবন্ধুদের প্ল্যাটফরমে রাজনৈতিক আলোচনার ওপর তাদের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ ও রহস্য উদ্ঘাটন আমার কাছে বেশ কঠিন মনে হয়। একইভাবে ক্ষমতাসীন সরকার সুস্থ ধারার রাজনীতির চর্চা উৎসাহিত করতে ভয় পায়। কারণ, এমন রাজনীতির মধ্যে ইনক্লুসিভ নির্বাচন দেওয়া হলে সরকার আবারও ক্ষমতায় আসতে পারবেন কি না, তা হয়তো তারা জানেন। এ জন্য সরকারও স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে ভয় পায় বলে প্রতীয়মান হয়। এ কারণে দেশে সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিক সুস্থ রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় বিবেকসম্পন্ন দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সক্রিয় হওয়া দরকার।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply