জনপদে জোয়ার-ভাটা, সড়ক পথে নৌকায় চলাচল, রোগ-বালাইয়ে চিকিৎসা না পাওয়াসহ খেয়ে না খেয়ে আধমরা জীবন নিয়ে চরম কষ্টে সময় পার করছে মানুষ। বছরের খুশির দিন ঈদেও তাদের ঘরে আনন্দ ছিলনা। টেকনাফ উপজেলার শাহপরীরদ্বীপের দুর্গত এরকম হাজারো মানুষের দুর্বিসহ জীবনের অবসান হবে কবে-এখন সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজছে দ্বীপের বাসিন্দারা। কেননা লোক দেখানো বাঁধ নির্মাণ এবং অনিয়ম-দূর্নীতিতে ভরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতি তাদের আস্থা নেই। উপকূলবাসীকে রক্ষায় সেনাবাহিনী দিয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবী জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অমাবস্যা কিংবা পুর্ণিমা শুরু হলেই বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের লোনাপানি ঢুকে প্লাবিত হয় টেকনাফের শাহপরীদ্বীপ, নাজির পাড়া ও পৌর এলাকার জালিয়াপাড়াসহ কয়েকটি জনপদ। বিধ্বস্থ বেড়িবাঁধ দিয়ে অমাবস্যার ভরা জোয়ারের পানি ঢুকে উপকূলের ২০ টিরও বেশী গ্রাম গত এক সপ্তাহ ধরে জোয়ার ভাটার নিচে। কেননা শাহপরীদ্বীপের ১ কিলোমিটার মিটার বেড়িবাঁধ একেবারেই বিলিন হয়ে গেছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আরো ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। কাঁটাবুনিয়া এলাকায় কয়েকশ’ একর ফসলি জমি জোয়ারের পানিতে ডুবে রয়েছে। টেকনাফ থেকে সড়ক পথে শাহপরীরদ্বীপ যাতায়াতের পাকা সড়কটি জোয়ারের পানিতে ডুবে আছে। লোকজনকে শাহপরীর দ্বীপে যেতে হচ্ছে গাড়ির বদলে নৌকায় চড়ে।
স্থানীয় সুত্র জানায়, এবারের ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলো টেকনাফ উপকূলের ৩০ হাজার মানুষ। অমাবস্যার ভয়াবহ জোয়ারের তাদের ঈদের আনন্দ ভেসে গেছে লোনা পানিতে। সামুদ্রিক জোয়ারের পানি ঢুকে ২০টিরও বেশী গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় তারা এবার ঈদ উদযাপন করতে পারেনি। পুরো দেশের মানুষ যখন আনন্দের জোয়ারে ভাসছিল-তখন তারা অপেক্ষায় ছিল কখন এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে।
দ্বীপের একাধিক বাসিন্দা জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতি তাদের আস্থা নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বাদ দিয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ পুন:নির্মানের জন্য এবং পুরাতন বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন ঠেকাতে পদক্ষেপ নেয়া জন্য সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিতে হবে। আর এই দাবী নিয়ে ঈদের পর দিন তারা বিলীন হওয়া বাঁধের উপর দীর্ঘ মানববন্ধন রচনা করেন।
শাহপরীর দ্বীপ রক্ষা কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বলেন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে এই দ্বীপের পশ্চিম অংশে (পশ্চিম পাড়ায়) এক কিলোমিটারের মতো বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এরপর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ওই ভাঙা অংশ সংস্কারের জন্য ৭০ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এই ভাঙা অংশে বেড়িবাঁধ তৈরি হয়নি, বরং এই কয়েক বছরে বেড়িবাঁধ ভেঙে দ্বীপের পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়া, মাঝরপাড়া, ঘোলাপাড়া, বাজারপাড়া, জালিয়াপাড়াসহ ২০ গ্রামের কয়েক হাজার একর ফসলি জমি সমুদ্রে বিলীন হয়েছে। ভেসে গেছে আট শতাধিক ঘরবাড়ি। এখনো কয়েক হাজার একর ফসলি জমি জোয়ারের পানিতে ডুবে দ্বীপটিকে মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
শাহপরীরদ্বীপের ক্ষমতাসীন দলের নেতা সোনা আলী অভিযোগ করেন, শাহপরীরদ্বীপটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের জন্য সোনার খনি। দীর্ঘদিন ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বারবার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়ায় তা রক্ষা করতে পারেনি। তারা দ্বীপের মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
বেড়িবাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মাঈন উদ্দিন’র সাথে সম্প্রতি সাংবাদিকদের বিস্তারিত আলাপ হয়। সেখানে বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের কথা তুলতে না তুলতেই তিনি সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে আসেন। রাগে-গোস্বায় ফেটে গিয়ে কারো সাথে কথা না বলার হুমকি দেন। তবে এক পর্যায়ে তিনি সাংবাদিকদের নিকট পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকের কাছে দ্বীপের ব্যাপারে বিস্তারিত রিপোর্ট করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
শাহপরীদ্বীপ উন্নয়ন ও রক্ষা কমিটির সভাপতি মাস্টার জাহেদ হোসাইন জানান, পাকা সড়কটি জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকায় দ্বীপের লোকজন টেকনাফ সদরে যেতে পারছেন না। বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় অসুস্থদের টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো যাচ্ছেনা। গত কয়েক দিনে পাঁচ-ছয় জন নারী-শিশুর মৃত্যু হয়েছে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শতাধিক ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ২৫ দিন ধরে।
এসব বেড়িবাঁধের পুন:নির্মানের কোন উদ্যোগ না নেয়ায় এসব ভাঙ্গন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান এলাকাবাসী। উপকুলের এই মানুষগুলোর দুর্বিসহ জীবনের কখন অবসান হবে সে আশায় জীবন কাটাচ্ছে উপকুলবাসী।
Leave a Reply