ফারুক আজিজ::::“লেইট্যার বউ” একটি গ্রাম্য প্রবাদ। গ্রামের গরীব অসহায় অতি সরল মানুষের বউকে সবাই ভাবি বলে ডাকে, তার সাথে সবাই মশকারি, রঙ- ঢঙ করে অবসর সময় কাটায়, সেই নারীও সবাইকে দেবর ভেবে কোন কিছু বলে না; শুধু হেসে উড়িয়ে দেয় সব। তার হাসির মূল্য কেউ বুঝেনা, সেই হাসির আড়ালে যে কতো দু:খ লুকিয়ে থাকে তা বুঝার মানুষ থাকেনা; সবাই শুধু আসা-যাওয়াতে “ভাবি” “ভাবি” বলে ডাক দেয়। কেউ জিজ্ঞেস ও করেনা ভাবির চুলাতে আজ উনুন জ্বলছে কি না। সবাই এতোটুকু বুঝে যে তার সাথে শুধু মশকারি, রঙ-ঢঙ করা যায়। কারণ সে অসহায়, সে নি:স্ব ও সে গরীব। তার কিছু বলার অধিকার নেই, প্রতিবাদ করার ভাষা
নেই ; যা আছে তা শুধু সহ্য করার, মেনে নেওয়ার ও চুপ করে থাকার। আবার তার মৃত্যুতে অনেকে কান্নার ভান_ও করে, আরো বলে বেড়ায় : কতো ভালো ছিলো মহিলাটি, এবং আরো কতো কি! কিন্তু তারা কোনদিন জিজ্ঞেস করে নাই তার বাড়িতে উনুন জ্বলছে কি না, দু’ মুটো খেয়েছে কি না, জ্বরে ধুকেধুকে মরে গেলেও একটি প্যারাসিটামল বা এইস প্লাস ও এনে দেয়নি; এমনকি তা জিজ্ঞেস ও করেনা। ওই ধরনের মানুষগুলি অন্যজনের মৃত্যুতে কান্নার ভান করতে পারে, বরং তাতে আনন্দ পায় আর বেদিতে ফুল দিতে জানে কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে ওই অসহায়ের বেঁচে থাকার জন্যে কোন সম্বল পোঁছাতে পারেনা। জানিনা, এটি তাদের স্বভাব না অভ্যাস!? এবার মূল পয়েন্টে আসি। সেই লেইট্যার বউয়ের মতো হলো আজ আমাদের শাহ পরীর দ্বীপ এবং তার জনগণের অবস্থা। সেই ২০১২ সালের ১২ জুন প্রবল বর্ষণে বঙোপসাগের বাঁধটি ভেঙে গিয়ে অধিকাংশ গ্রাম পানিতে প্লাবিত হলো, পানির সাথে মিশে গেলো কতো মসজিদ ও মক্তব, আর কতো মানুষের বসতবাড়ি পানির সাথে মিশে গেলো। সাথে সাথে তলিয়ে গেলো হাজার হাজার স্বপ্ন। এমন কি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে স্বাধীন এই জনপদ। তবু তারা একটু বাঁচতে চায়, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন ফিরে পেতে চায়, পানির তলে মিশে থাকা জমিনে আবারো ধান চাষ করতে চায়, রাখালেরা গরু নিয়ে আবার একটু গান ধরতে চায়, সর্বোপরি তারা নিরাপদে চলাচল করতে চায়। কিন্তু কে শুনে কার কথা!? কতোবার বাঁধ মেরামতের কথা এলাকাবাসী শুনেছে, তখন তারা জড়ো হয়ে বলাবলি করে ” এই পরীর মতো দেশ আবার পরীর মতো হবে সেই পরীবানুকে আমরা আবার আমন্ত্রণ করবো, তাকে বলবো এবার কিন্তু শাহ সুজাকে ছাড়া আসিও” পরীবানু আর শাহ সুজা উদ্দিনের নামে এই দ্বীপের নামকরণ বলে অনেকেই বলে। পরীবানু হচ্ছে মোগল সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজার স্ত্রী। তারা একবার এই দ্বীপে অবস্থান করেছিলো, সেই অবস্থানের পরিপেক্ষিতে এই দ্বীপের নামকরণ। তবে ভিন্নমত ও আছে। তাই তারা যখন-ই এই দ্বীপ মেরামতের কথা শুনে, তখন-ই তাদের চোখে মুখে আনন্দের রাণীরা খেলা করে। প্রতিদিন সকালে উঠে তাদের প্রথম চাওয়া আর পাওয়া এটাই হয় যে স্বপ্নের দ্বীপ মেরামত হোক। বসত বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ভাই বেরাদর আবার আসুক। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি এই দ্বীপ এবং দ্বীপের সরলমনা মানুষদের সাথে শুধু মশকারি করেনা; প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে। কতো নেতা বাঁধ মেরামত করে দিবে বলে ভোট চায়, আর এই দ্বীপের মানুষ বাঁধ ভাঙা খুশিতে মন না চাইলেও ভোট দিয়েছে এবং জনপ্রতিনিধি করেছে কিন্তু এই সরলমনা মানুষের আশা আশা-ই রয়ে গেলো। তাদের অন্তরের ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায়নি, বরং দিনদিন ক্ষত বড়ো হচ্ছে। কিছুদিনপর আবার বর্ষাকালের অমাবস্যার জোয়ারের পানির স্রোত ধেয়ে আসবে টিকে থাকা মানুষের বসতবাড়িতে, অসহায় মানুষের বুকে, চোখে। কিন্তু কে দেখে এই অসহায় চোখের চাহনির নিচে জমে থাকা অশ্রু জমাট!? কে শুনে অসহায় হৃদয়ের আর্তচিৎকার!? কে বুঝে অসহায়দের মনের এই ছোট্ট চাওয়া!? হয়ত এভাবে লেইট্যার বউয়ের মতো ধুকেধুকে নি:শ্বেস হয়ে যাবে এই পরীর মতো দেশ, সাগরের সাথে একাকার হয়ে যাবে মানুষের নিষ্পাপ স্বপ্নগুলি, এবং স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে মুছে যা
বে এই ভূখণ্ড। কিন্তু মনে রাখবেন, এই হাজার হাজার বনি আদমের চোখের পানিতে একদিন তলিয়ে আপনাদের আধিপত্য ও রঙ-ঢঙ। লেখক ফারুক আজিজ ছাত্র : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ফাযেল : জামিয়া ইসলামিয়া, পটিয়া, চট্টগ্রাম। ০১৮১৪৮২০৮৩৩
Leave a Reply