টেকনাফ নিউজ ডেস্ক…সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সতর্ক প্রহরা সত্ত্বেও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ রোধ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। এর ফলে বাংলাদেশে দুঃসহ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশজনিত প্রতিকূলতার সৃষ্টি হচ্ছে। গত তিন দশকে বাংলাদেশকে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা উদ্বাস্ত সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার চাপে এমনিতেই নুইয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। জনসংখ্যার দিক থেকে এ দেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম । তার ওপর মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা এ দেশের জন্য বাড়তি বোঝা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রসঙ্গত, সত্তরের দশকের শেষে আর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের প্রত্যাবাসন করানোটা যে বাংলাদেশের জন্য কেবল কষ্টসাধ্য হয়েছে তা নয়, শরণার্থী হিসাবে আসা অনেক রোহিঙ্গা এখনো এ দেশে রয়ে গেছে। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যমতে, কক্সবাজার এবং বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা। তবে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। এরা খাস জমিতে গড়ে তুলেছে বসতি। অনেকে জড়িত হচ্ছে নানা অসামাজিক কার্যকলাপে। তাদের কারণে স্থানীয়রা বেকার হচ্ছে। ফলে এ সব এলাকায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। জানা গেছে, কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশেও ভোটার হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের কিছু চেয়ারম্যান ও মেম্বার ভোটব্যাংক সৃষ্টির লক্ষ্যে এদের ভোটার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামে যেসব রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছে তাদের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বেশিরভাগই টেকনাফ কিংবা উখিয়া ব্যবহার করেছে।
কক্সবাজার জেলার প্রায় প্রতিটি হোটেলে কর্মকর্তা–কর্মচারী পদে এসব রোহিঙ্গা শরণার্থী চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে। এছাড়াও রিকশা ও টেক্সি চালক বেশে , কেউবা রংমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রিবেশে চট্টগ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিকাদারদের কাছেও শ্রমিক হিসেবে এদেশীয়দের তুলনায় বেশি পছন্দ রোহিঙ্গা শ্রমিক। কারণ অভাবের কারণে এসব রোহিঙ্গা শ্রমিকেরা অল্প বেতনে তুষ্ট থাকে। এখন এ রোহিঙ্গারা জীবন–জীবিকার তাগিদে স্থানীয় শ্রমবাজার দখল করে ফেলায় স্থানীয়রা কার্যত বেকার হয়ে পড়ছে। এ কারণে অবৈধ এ রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ। তারপর আরও ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর পরিকল্পনা মিয়ানমারের রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে সরকারি তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১০ হাজার ৪০০ জন। এর বাইরে ওই এলাকায় তালিকা বহির্ভূত আরও প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। অন্যদিকে টেকনাফের নয়াপাড়া শিবিরে তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এ ক্যাম্পের সন্নিকটে লেদা বস্তিতে অবস্থান করছে আরও প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা। তাদের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। এ দুটি ক্যাম্পে অবস্থানরত লক্ষাধিক আনরেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে সরকারি–বেসরকারি কোনো সংস্থার মাথাব্যথা নেই। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনও আনরেজিস্ট্রার্ড শরণার্থীদের কোনো রকম সাহায্য–সহযোগিতা দিচ্ছে না। জানা গেছে, মিয়ানমার সরকারের কালো তালিকাভুক্ত অনেক রোহিঙ্গা ছদ্মনাম ব্যবহার করে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। মিয়ানমার সরকারের কাছে তাদের নামের তালিকার সাথে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নামের তালিকার মিল নেই। তাই শরণার্থী শিবিরে থাকা ২৮ হাজার রোহিঙ্গার মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। শরণার্থী ক্যাম্পে নাম লিখিয়ে এরা জাতিসংঘের রেশন ভাতা ভোগ করছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কৌশলে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। সেখানে তাদের নানা অপকর্মের দায়ভার বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশী শ্রমিকদেরই। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. জয়নুল বারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশের জন্য চরম ক্ষতি বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনগণের জন্য যেমন ক্ষতির কারণ, তেমনি নানা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নেরও অন্তরায়। তাদের কারণে চুরি–ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যতোদূর সম¢ব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে কাজ করে চলেছি। বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ সকলেই এ ব্যাপারে আন্তরিকভাবে কাজ করে চলেছে। কিন্তু এর পাশাপাশি সামাজিকভাবে যদি প্রতিরোধ না করা যায়, তবে এটি আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে অচিরেই।’
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে উখিয়া ও টেকনাফে গঠিত হয়েছে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটি। টেকনাফ রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির নেতা জাবেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের লেদায় দুটি ক্যাম্পে লক্ষাধিক আনরেজিস্ট্রার্ড রোহিঙ্গার বিষয়ে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে এদের তালিকাভুক্ত করা হলে অন্তত তাদের খাদ্য বরাদ্দ জাতিসংঘ তহবিল থেকে পাওয়া যেত।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের গা ছাড়া ভাবের আরো একটি কারণ বাংলাদেশের সমুদ্র জয় বলে মনে করছেন টেকনাফের সাধারণ জনগণ। টেকনাফ নয়াপাড়ার ব্যবসায়ী ইকবাল শরীফ বললেন, ‘গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার সমুদ্র সীমা সংক্রান্ত মামলায় হেরে যায়। হয়ত এই ক্ষোভ থেকেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে, যাতে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে সংকট তৈরি করতে পারে।’ এই ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারকে কোন ধরনের ছাড় না দেয়ার আহবান জানান তিনি।
বিজিবি ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নাফ নদীতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ১৫০ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। সীমান্ত পাহারায় বিজিবির ৮২০ জন সদস্য মোতায়েন থাকে। কোস্টগার্ডেরও থাকে প্রায় ২০০ জন। টেকনাফে বিজিবির এক কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পর অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। এ কর্মকর্তার মতে, মিয়ানমার সরকার সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে আরাকানকে রোহিঙ্গাশূন্য করার জন্য।
জানা গেছে চলতি বছর ২৪ মে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও নাসাকা বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে কক্সবাজারে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার নাগরিকদের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ, সীমান্তের জিরো লাইন থেকে ১৫০ গজের বাইরে কাঁটা তারের বেড়া সরিয়ে নেওয়া এবং কারাভোগের পর কক্সবাজার জেল থেকে ৫৫ জন মিয়ানমারের নাগরিককে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। বৈঠকে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ, মাদক পাচার রোধ ও সীমান্ত চোরাচালান রোধে উভয় বাহিনী এক সাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আজো সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত না হওয়ায় রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অনুপ্রবেশ রোধ করা যাচ্ছে না কিছুতেই।
Leave a Reply