প্রফেসর আবদুল মান্নান…আমাদের একেবারে বাড়ির পাশে বার্মা মুল্লুকে অনেক কাল ধরে সরকারিভাবে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে জাতিগত দাঙ্গার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চলছে এবং তা দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একেবারে চুপ। বার্মা মুল্লুকের বর্তমান নাম মায়ানমার। দেশটি দীর্ঘ প্রায় অর্ধশতক ধরে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সম্প্রতি সে দেশে আবার গণতান্ত্রিক ধারা ফিরতে শুরু করেছে বলে বিশ্বসম্প্রদায় মনে করে। তাদের ধারণা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতনের বিষয়ে বেশি চাপাচাপি করলে সে দেশে আবার গণতন্ত্র হুমকির সামনে পড়তে পারে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মুক্ত মানুষ হিসাবে বাস করতে পারা উচিত। তা যদি নাই হবে তাহলে সে দেশকে কোনভাবে গণতান্ত্রিক দেশ বলা যাবে না। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের একেকটি দেশের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আবার একেকরকম। যে মানুষগুলো সে দেশে নির্যাতিত হচ্ছে তারা জাতে রোহিঙ্গা, ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। বেশির ভাগেরই আবাস উত্তর আরাকান প্রদেশে। তারা সেখানে কী ভাবে এলো তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন রোহিঙ্গারা আরব দেশ থেকে এসে সেখানে বসতি গেড়েছিল সেই অষ্টম শতকে। কারো কারো মতে তারা ভারতবর্ষের গুজরাত অঞ্চল ও আফগানিস্তান হতে সেখানে হিযরত করে চাষবাস শুরু করেছিল। এলাকাটি চট্টগ্রামের সংলগ্ন হওয়াতে তাদের সাথে চট্টগ্রামের মানুষের উঠবস বেশি ছিল। তাদের ভাষার সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার বেশ মিল আছে। যেখান থেকেই তারা আসুক না কেন তারা এখন মায়ানমারের অধিবাসী। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে পরবর্তীকালের মায়ানমারের কোন সরকারই তা স্বীকার করেনি এবং যুগ যুগ ধরে তারা নির্যাতিত হয়েছে। বার্মার সরকার সব সময় মনে করে বার্মায় একেবারে স্থানীয় ও বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছাড়া সকলেই বহিরাগত। ভারতীয় হলে তো কথাই নেই। বর্তমানে সে দেশে প্রায় ত্রিশ লক্ষ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে বাস করে। চীনা ও মালয়ের মুসলমানদের অবস্থাও একই রকম। তবে তাদের সংখ্যা রোহিঙ্গাদের চাইতে কম। কথায় কথায় সকলে নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হয়। সে দেশে ১৩৫টি আদিবাসীকে সরকারিভাবে নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে শুধু রোহিঙ্গারা। তাদের অপরাধ তারা ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান এবং গায়ের রং কালো।
এবার আমার বাবার কথা বলি। ত্রিশের দশকে তার যৌবনকাল। ভাগ্য ফেরাতে ছুটলেন বার্মা মুল্লুকে। তখন অবিভক্ত বাংলারতো বটেই, সারা ভারতবর্ষের মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ছুটতেন রেঙ্গুন না হয় আকিয়াবে। এই অঞ্চলের একমাত্র সমৃদ্ধশালী দেশ তখন বার্মা। চট্টগ্রামের মানুষ সমুদ্রপথে এক সকালে যাত্রা করে পরদিন আকিয়াব পৌঁছে যেত, কয়েকদিন পর রেঙ্গুন বন্দরে। সে দেশে বিয়েশাদীও করেছেন অনেকে। বাবা ছোটখাট একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছিলেন। তবে তার দোকানের বেশির ভাগ খদ্দের ভারতীয়। কদাচিৎ কোন স্থানীয় মানুষ দোকানে প্রবেশ করতো। বাবা চাচাদের কাছে শুনেছি বার্মিজ মেয়েদের কাছে ভারতীয় পুরুষদের কদর ছিল বেশ। তাদের বিয়ে করার একধরনের আকুতিও নাকি ছিল। অবশ্য তিনি সে খপ্পরে পড়েননি। আয় রোজগার ভাল ছিল। ব্যাচেলর মানুষ। কিছু টাকা জমিয়ে একটা গাড়িও নাকি কিনেছিলেন। ট্যাক্সি হিসাবে চলতো।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। জাপানিদের হাতে সিঙ্গাপুর পতনের পর ১৯৪২ সনে বার্মার পতন হলো। বাবা বলতেন, বার্মিজরা সম্ভবত এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রথম সুযোগেই জাপানি সৈন্যদের সাথে নিয়ে শুরু করে দিল ভয়াবহ দাঙ্গা। এটি ছিল ভারতীয়দের বার্মা থেকে উৎখাত করার দাঙ্গা। বাবা হাজার হাজার ভারতীয়দের সাথে এক কাপড়ে হেঁটে রওনা দিলেন দেশের উদ্দেশে। প্রায় একমাস চলার পর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। পথে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির ধর্ম, তা সারা বিশ্বে স্বীকৃত একমাত্র বার্মা ছাড়া।
বার্মায় বর্ণ এবং জাতি বিদ্বেষ এখনো প্রকট। অথচ এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্পূর্ণ নীরব। বার্মায় বসবাসরত নাগরিকদের দু’ধরনের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। একটি লাল রং এর অন্যটি সাদা। লালটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বার্মিজদের। অন্যটি সাদা, পেছনে লেখা থাকে এই কার্ডধারী বার্মার নাগরিক নয়। রোহিঙ্গাদের কার্ডের পিছনে লেখা থাকে এর বাহক একজন বাঙালি মুসলমান। এটি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে একবিংশ শতকে এসেও নাৎসি জার্মানির একটি মডেল রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নিয়েছে এবং ইদানিং সকলে মায়ানমারের নতুন সরকারকে হাত কচলে বেশ খোসামোদ করছে।
উত্তর আরাকান প্রদেশ বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন এলাকা। এখানকার রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের হাতেই তারা সর্বাধিক নিগৃহীত হয়। এদের বিয়ে করতে হলে প্রশাসন থেকে পূর্বানুমতি নিতে হয় যা সচরাচর মিলে না। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। রোহিঙ্গাদের এখান হতে অন্য প্রদেশে যাওয়া বেআইনি। মায়ানমারের সেনা ও পুলিশবাহিনীতে কোন রোহিঙ্গা মুসলমানের চাকরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। স্থানীয় রাখাইনরা সুযোগ পেলেই দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু করে। এসবের কোন বিচার কখনো হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরাকান রাজ্যে প্রথম বড় ধরনের দাঙ্গা হয় ১৯৬২ সালে। তখন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয় এবং তারা কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। কয়েক হাজার থাইল্যান্ডেও চলে যায়। সে সময় যারা চট্টগ্রামে এসেছিল পরবর্তীকালে তারা এখানকার মানুষের সাথে মিশে গেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে রোহিঙ্গাদের প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ এবং ১৯৭৯ সালে যখন আরাকানে বার্মার সেনাবাহিনী অপারেশন ‘নাগামিন’ নামে একটি জাতিগত শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। সে ধাক্কায় বাংলাদেশে প্রায় দুই লক্ষ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়া সমস্যাটির কোন কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা না করে নাফ নদীতে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ পাঠায়। সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। পাল্টা বার্মাও একই কাজ করে। কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়। আরেকটি ধাক্কা আসে ১৯৯০-৯১ সনে যখন প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মায়ানমারের সামরিক জান্তার এমন অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ করার জন্য একটি দেশও বাংলাদেশের পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়ায়নি। শুধুমাত্র জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর কিছু রিলিফ সামগ্রী নিয়ে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, কুতুপালং প্রভৃতি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তাদের পাশে দাঁড়ায়, তবে তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
বর্তমানে সরকারিভাবে দুটি শরণার্থী শিবির আছে। বাংলাদেশ মাঝে মাঝে মায়ানমারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফেরত পাঠাতে কয়েকবার চেষ্টা করেও তেমন একটা সফল হয়নি। তারা শুধু কয়েক হাজার শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিয়ে সাফ জানিয়ে দেয় বাকিরা তাদের দেশের নাগরিক নয়। বাংলাদেশের মতো একটা দেশের পক্ষে সম্ভব নয় কয়েক লক্ষ শরণার্থীকে বছরের পর বছর চারিদিকে তারকাঁটার বেড়া দিয়ে আটক করে রাখা। বর্তমানে দুই ক্যাম্পে শুধু মাত্র ত্রিশ হাজারের মতো তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা আছে, বাকিরা দেশের জনারণ্যে মিশে গেছে এবং বিভিন্ন সময়ে তারা এক শ্রেণির দালাল আর অসাধু সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে শুধু চলেই যায়নি, সে সব দেশে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের সুনামের যথেষ্ট ক্ষতিও হয়েছে।
অন্যদিকে তাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে মাদক ব্যবসা এবং নারী ও শিশু পাচারসহ নানা অপকর্মের সাথে বর্তমানে জড়িত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকশত রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছে। চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের চারপাশের সকল খালি যায়গা ইতোমধ্যে তাদের দখলে চলে গেছে। এলাকাটি হয়ে পড়েছে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। তবে সবচাইতে ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন জঙ্গি তৈরির প্রজননক্ষেত্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এদের নিয়ে গোপনে কাজ করে সৌদিআরব ভিত্তিক রাবিতা আল ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, হেফাজতে ইসলাম সহ অনেক ধর্মান্ধ মৌলবাদী দল ও জঙ্গিবাদী সংগঠন।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সবচাইতে হতাশাজনক ভূমিকা পালন করেছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত অং সান সু চি। এই ব্যাপারে তার কোন কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়ে না। সম্প্রতি তিনি ওসলোতে একুশ বছর পূর্বে তাকে প্রদত্ত শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে তার বক্তৃতায় বলেন, প্রবাসী বার্মিজরা মায়ানমারে সকল নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মাঝে শান্তি ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যস ওইটুকু।
সম্প্রতি নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্কের জন্ম হয়েছে। সরকার নতুন করে কোন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দিতে নারাজ। সার্বিক বিচারে এটি সরকারের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে অনেকে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে সরকারের উচিত আরো একটু মানবিক হওয়া। এই প্রসঙ্গে দেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন। জামায়াত-বিএনপি বলেছে সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া। একজন সিনিয়র সাংবাদিক কলাম লিখে বলেছেন রোহিঙ্গাদের যেন আবার বাঘের মুখে ঠেলে দেওয়া না হয়। সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্য পত্রিকায় মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে তার রাতে ঘুম হয় না। জাতিসংঘ আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে। জামায়াত আর বিএনপি’র বলার মধ্যে একটা বড় বদমতলব আছে। বিএনপি আমলে এই রোহিঙ্গাদের অনেকেই ভোটার হয়েছে। সে ভোট তাদের বাক্সে পড়বে। তাদের আমলেই সব চাইতে বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গেছে। জামায়াত ও সমমনা দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এদেরকে তাদের জেহাদি আর সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করবে। এদের প্রতি আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়ের জন্য এরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত মাইলাই গণহত্যার একটি ছবি তারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ছবি বলে ইন্টারনেটে আপলোড করেছে। অন্য আর একটি ছবি আছে যেটি আসলে থাই পুলিশের হাতে ধৃত গোটা পঞ্চাশেক রোহিঙ্গার। পুলিশ তাদের সমুদ্রের বালিতে উপুড় করে শুইয়ে রেখেছে। কিন্তু ছবির ক্যাপসান দেওয়া আছে, বার্মার সেনাবাহিনীদের রোহিঙ্গা মেরে ফেলে রেখেছে। টেকনাফে বেশ কিছু মোবাইল ফোনের দোকানে কিছু হিন্দী ছবির নির্যাতনের দৃশ্যের ক্লিপিং পাওয়া যায় যা রোহিঙ্গা নির্যাতনের ছবি হিসাবে মোবাইলে ডাউন লোড করে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এটি সত্য, সাম্প্রতিক দাঙ্গায় অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে, অনেক নারী ধর্ষিত হয়েছে। তবে এই ছবিগুলোর কোনটাই সে সবের নয়। টেকনাফ আর কক্সবাজারে জামায়াতের নেটওয়ার্ক বেশ শক্তিশালী। শোনা যায়, অনেক রোহিঙ্গা গোপনে জামায়াতিদের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছে। পুরো এলাকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার দাবি সম্বলিত পোস্টারে ছেয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা এখানে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। ইতোমধ্যে এই সব এলাকার দিনমজুরদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ দানা বাঁধছে কারণ যেখানে একজন দিনমজুরের দৈনিক পারিশ্রমিক দেড় থেকে দুই শত টাকা সেখানে একজন রোহিঙ্গা শ্রমিক পাওয়া যায় পঞ্চাশ টাকা দিয়ে। যারা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে বলেন তারা এখানকার বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত নন। বাংলাদেশ অতীতে সব সময় মানবিক আচরণ করেছে, এখনো করছে। কিন্তু তাতে ফলাফল শূন্য। এই বিষয় সম্পর্কে আমাদের বিশিষ্টজনেরা একেবারেই নিশ্চুপ।
কেউ কেউ অনেকটা অর্বাচীনের মতো রোহিঙ্গাদের সমস্যাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের পরিস্থিতির সাথে তুলনা করেন। একাত্তর সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। সেই যুদ্ধে এক কোটি বাঙালি শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা একটা প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলাম। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তারা যাতে নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যায় সেই চেষ্টা করেছিল ভারত। যুদ্ধ শেষে দ্রুততম সময়ে প্রত্যেক বাংলাদেশি নিজ দেশে ফিরে এসেছিলেন। ভারতে থেকে গিয়েছে তেমন বাঙালি হাতে গোনা যায়। একাত্তরের বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাথে রোহিঙ্গাদের তুলনা করা চরম মূর্খতার শামিল। এটি ঠিক মায়ানমার বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। তাদের সাথে আমাদের অনেক অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। তথাপি রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ চুপ করে থাকতে পারে না। এই ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য সকল ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। প্রয়োজনে বিষয়টি জাতিসংঘের নজরে আনতে হবে। এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত তেমন কিছু করবে বলে মনে হয় না কারণ নতুন মায়ানমারের অফুরন্ত সম্পদ ও সম্ভাবনার দিকে এখন তাদের সকলের লোলুপ দৃষ্টি। সকলে নিজের স্বার্থ রক্ষাকে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দেয়। কিছুদিনের মধ্যে মায়ানমারের রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। বাংলাদেশকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার বিষয়ে নিশ্চয় আলাপ হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একটি সমস্যা জিইয়ে রেখে কোন সম্পর্কই যে কার্যকর হবেনা তা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মায়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা সমস্যার মীমাংসা করেছে। এই সমস্যারও সমাধান হবে তা মানুষ আশা করতেই পারে। এটি যত না গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য, তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মায়ানমারের জন্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে একটি নতুন গণতান্ত্রিক মায়ানমারের অভ্যুদয় অধরাই থেকে যাবে। বিএনপি-জমায়াতের কথা বাদ দিলাম। বাকি যারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে ওকালতি করছেন। তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি বাস্তবতাটা উপলব্ধি করুন, নিজের দেশের স্বার্থকে সকলের উপরে স্থান দিন। এখনো বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণ রোহিঙ্গাদের প্রতি অনেক মানবিক আচরণ করছে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। জুন ২২, ২০১২
Leave a Reply