মানবজমিন ডেস্ক: রোহিঙ্গাদের সহায়তাকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওপর থেকে ‘শাস্তিমূলক’ নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। একই সঙ্গে তারা
শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মেনে বাংলাদেশ সরকারকে তা করতে হবে। আর তা না হলে সৃষ্টি হতে পারে এক বিরাট মানবিক বিপর্যয়। এ সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে দু’লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান রয়েছে। তাদেরকে জীবন রক্ষাকারী মানবিক সহায়তা দেয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। তাদের ওপর থেকে অবিলম্বে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত বাংলাদেশের। এছাড়া, মিয়ানমারে দাঙ্গার প্রেক্ষিতে যেসব রোহিঙ্গা পালিয়ে আসছে তাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়ার আহ্বান জানায় এইচআরডব্লিউ। নিউ ইয়র্কভিত্তিক এ সংগঠনটি বুধবার এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ‘বাংলাদেশ: অ্যাসিস্ট, প্রটেক্ট রোহিঙ্গা রিফিউজিস; হিউম্যানিটারিয়ান এইড ডেসপারেটলি নিডেড; ক্রাইসিস সিচুয়েশন ইন বার্মা কন্টিনিউস’। এতে বলা হয়, জুলাই মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকার প্রথম সারির আন্তর্জাতিক তিনটি সাহায্যদাতা সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস্, অ্যাকশন এগেইনস্ট হাঙ্গার ও মুসলিম এইডের কর্মকাণ্ডের ওপর কক্সবাজার ও এর আশপাশের এলাকায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিফিউজিস প্রোগ্রামের পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেন, বাংলাদেশে যেসব রোহিঙ্গা অবস্থান করছে তাদের অবস্থা সরকার এমন করার চেষ্টা করছে যাতে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। এর কারণ, মিয়ানমার ছেড়ে যেসব মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে তারা যাতে আর না আসে। তিনি বলেন, এটা এক নিষ্ঠুর ও অমানবিক নীতি। এই নীতি অবিলম্বে পাল্টে ফেলা উচিত। যেসব মানবিক সাহায্যদাতা সংস্থা রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিচ্ছে তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধ না করে তাদেরকে বাংলাদেশ সরকারের স্বাগত জানানো উচিত। মধ্য জুন থেকে মিয়ানমার ছেড়ে আসা কমপক্ষে ১৩০০ রোহিঙ্গাকে ফিরে যেতে বাংলাদেশ বাধ্য করেছে বলে স্বীকার করা হয়েছে। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হত্যা, লুট ও দাঙ্গা চলছে। পাশাপাশি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার মনে করে কক্সবাজারে সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর উপস্থিতি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসাকে উৎসাহিত করবে এবং তাদেরকে ধারণ করার ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশ সরকার অভিযোগ করছে, পালিয়ে আসা ওইসব রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা ও অন্য সহযোগিতা করে ওই ৩টি সাহায্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশকে উৎসাহিত করছে। এ নিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সমালোচনার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন ইকোনমিক, সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল রাইটস স্বাক্ষরকারী একটি দেশ বাংলাদেশ। তাই তার সীমান্তের ভিতরে যারা শরণার্থী, আশ্রয় চাইছে, খাদ্য চাইছে, স্বাস্থ্য সেবা চাইছে, এছাড়া অন্যসব নিরাপত্তা চাইছে সেইসব মানুষকে বাধা দিতে পারে না বাংলাদেশ। ওই তিনটি সাহায্যদাতা সংস্থা রোহিঙ্গা শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের মাঝে পানি, স্বাস্থ্যসেবা, পয়ঃনিষ্কাশন ও অন্যান্য মৌলিক সহায়তা দিয়ে আসছিল। সরকারিভাবে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তারা দু’টি শিবিরে বাস করছে। কিন্তু ৪০ হাজার অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বাস করছে অস্থায়ী শিবিরে। এছাড়া, বাকি আরও ১ লাখ ৩০ হাজার শরণার্থী অবস্থান করছে আশপাশের এলাকায়। সবগুলো আশ্রয় শিবিরই নোংরা ও ঘনবসতিপূর্ণ। সেখানে গাদাগাদি করে বসবাস, খাদ্য স্বল্পতা থেকে শিশুদের মধ্যে ব্যাপক হারে দেখা দিচ্ছে পুষ্টিহীনতা। রয়েছে পরিষ্কার পানির সঙ্কট ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। এগুলোর ফলে রোগ ছড়াচ্ছে। এর সঙ্গে সাহায্য সংস্থাগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে সেখানে জুলুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় সেখানে সরকারি, অনিবন্ধিত ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় চলমান মানবিক সঙ্কটকে জরুরি অবস্থায় নিয়ে গেছে। সাহায্য কর্মীরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, তারা বিশ্বে যত আশ্রয়শিবির দেখেছেন তার সবচেয়ে খারাপ আশ্রয়শিবিরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের শিবির অন্যতম। বিল ফ্রেলিক বলেছেন, সাহায্যদাতা সংস্থাগুলোকে ওইসব শরণার্থীকে খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা দেয়া বাংলাদেশ সরকার জোর করে বন্ধ করে দিয়ে শরণার্থীদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের কাছে যে সহায়তা এতদিন পৌঁছাচ্ছিল তা বন্ধ করে দেয়ায় রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি। তাদের এই অবস্থা বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে তৈরি করেছে। এটা অভাবনীয়। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আরাকান রাজ্যে বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা, রোহিঙ্গা নয় এমন মুসলমানের মধ্যে গত জুনের শুরুর দিকে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এতে ১ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। সেখানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ দাঙ্গা, হত্যাকাণ্ড, প্রহার, ধর্ষণ, গণগ্রেপ্তার ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে তা থেকে দু’সম্প্রদায়কেই রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার। আরাকান রাজ্যে দাঙ্গাকবলিত এলাকায় জাতিসংঘ এখনও পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা দিতে পারে নি। গত ৪ঠা আগস্ট আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন মিয়ানমারে জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোটিউর টমাস কুইনতানা। তিনি আরাকান রাজ্যে মানবাধিকার পরিস্থিতিকে গুরুতর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দাঙ্গা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিরাপত্তার জন্য পালিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। কিন্তু তারা দেখতে পায় সীমান্ত সিল করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার পুশব্যাক নীতি গ্রহণ করেছে। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডস সদস্যরা সমুদ্রে ছোট্ট নৌকায় করে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে বাধ্য করছে। ১৮ই জুন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক গবেষক প্রত্যক্ষ করেন, বন্দর নগরীর কাছে শাহপরীর দ্বীপ থেকে রোহিঙ্গাদের ৯টি নৌকা মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। তখন বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডসের সিনিয়র কর্মকর্তারা বলেছেন, তখন পর্যন্ত তারা ১৩০০ রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করেছেন। ২৯শে জুলাই এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, এদের দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে এমনিতেই জনসংখ্যা অত্যধিক। তার ওপর আমরা এই দায় বহন করতে পারি না। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এটা সত্য নয়। রোহিঙ্গাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডস সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বলেছেন, তাদের উচিত তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়া। এ কথা বলার পর তারা চলে গিয়েছে। একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মিয়ানমার তার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তারাই রোহিঙ্গাদের সব ধরনের সহযোগিতা ও সবকিছু সরবরাহ দিচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জুনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মিয়ানমার থেকে যে নতুন শরণার্থী আসছে তাতে আমাদের কোন আগ্রহ নেই। ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশন অথবা এর ১৯৬৭ সালের চুক্তিতে বাংলাদেশ সই করেনি। কিন্তু তাছাড়াও আন্তর্জাতিক কিছু আইন আছে যার নীতি মেনে চলতে সরকার বাধ্য। এর মধ্যে রয়েছে, কোন শরণার্থীকে জোর করে সেখানেই ফেরত পাঠানো যাবে না যেখানে তার জীবন ও স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে। কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চার, ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস ও কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড সহ বেশ কিছু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। তাতে বলা হয়েছে, শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীকে সেখানে ফেরত পাঠানো যাবে না যেখানে তারা নির্যাতনের ঝুঁকির মুখে পড়বে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে মানবিক সাহায্য দাতা ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোকে অনুমতি দেয়া। একই সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় মিডিয়ার অবাধ ও প্রতিবন্ধকতাবিহীন প্রবেশের সুবিধা দেয়া। দাতা দেশ ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সহযোগিতা ও সমর্থনের পক্ষে প্রস্তুত থাকা উচিত। তাদের উচিত মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রতি পূর্ণাঙ্গ সম্মান দেখানোর জন্য চাপ দেয়া। বিল ফ্রেলিক বলেন, বাংলাদেশে যে শরণার্থী শিবির আছে সেগুলো কোন পর্যটন কেন্দ্র নয়। সরকারের উচিত এটা মেনে নেয়া যে, রোহিঙ্গারা তাদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা না মেনে বাংলাদেশ সরকার তাদের দুর্ভোগকে জটিল করে তুলছে। তাদের উচিত নীতি পরিবর্তন করা এবং অস্থায়ী নিরাপত্তা দেয়া। পাশাপাশি সাহায্য সংস্থাকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অনুমতি দেয়া। আর তা না হলে এতে এক বিরাট মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
Leave a Reply