সদ্য পুন:নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মিয়ানমার সফরকে সামনে রেখে উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এবং গ্রামবাসীদের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে সে দেশের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল কুতুপালং শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আসেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিভিলিয়ান সিকিউরিটি ডেমোক্রেসি ও হিউম্যান রাইটস বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারী মারিয়া অথেরো, ডেপুটি এ্যাস্সিটেন্ট সেক্রেটারী কেলি ক্লেমেন্টস ও বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা শুক্রবার (১৬ নভেম্বর) বেলা ১২টায় উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তি ও নিবন্ধিত শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন।
সরজমিন জানা যায়, আন্ডার সেক্রেটারী মারিয়া অথেরোর নেতৃত্বে উক্ত উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বেলা সাড়ে ১১ টায় কুতুপালং পৌঁেছ প্রথমে এমএসএফ (হল্যান্ড) পরিচালিত হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম পরিদর্শন ও সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স ও রোগীদের সাথে কথা বলেন এবং রোগীদের কাছ থেকে চিকিৎসা সেবার মান সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। সেখানে প্রায় ২০ মিনিট সময় কাটান। বেলা ১২টায় ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকের অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তিতে ঢুকে কয়েকটি পরিবারের সাথে কথা বলেন এবং তাদের খোঁজ খবর নেন। এ সময় বস্তিতে বসবাসরত নবী হোছনের শিশু মোঃ ত্বোহা (৮) এর কাছে মারিয়া অথেরো পড়া লেখা করে কিনা এবং কিভাবে জীবন-যাপন করে জানতে চায়। রোহিঙ্গা বস্তি হয়ে অভ্যন্তরিন পদ দিয়ে পায়ে হেঁটে নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরে গিয়ে বিভিন্ন পরিবারের সাথে কুশল বিনিময় করেন। ই-ব্লকের ৫০ নং শেডের সোনা মিয়ার ছেলে মোঃ তারেক (১৫) মারিয়া অথেরোকে সালাম দিয়ে তার পরিচয় দেন। সে ইংরেজী ভাষায় কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়া-লেখা করে বলে জানান। তার সাথে কয়েক মিনিট মারিয়া অথেরো ও মর্জিনা কথা বলেন। শিবিরে তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। এর উত্তরে তারেক এনজিও ও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে বলে উল্লেখ করে সরকারের প্রশংসা করেন। নিবন্ধিত শিবিরের পশ্চিম দিক হয়ে ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে আসার পথে বেশ কিছু শিশু ও মহিলারা ইংরেজীতে লেখা বিভিন্ন শ্লোগান সম্পর্কিত প্লেকার্ড ও ব্যানার প্রদর্শন এবং আন্ডার সেক্রেটারী মারিয়া অথেরোর দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা চালান। এ সময় প্রতিনিধি দল এসব প্লেকার্ড ও ব্যানার পড়ে দেখেন এবং মহিলা ও শিশুদের সাথে কথা বলেন। প্রতিনিধি দল চলে আসার সময় সেখান থেকে বোরকা পরিহিত এক রোহিঙ্গা মহিলা হঠাৎ করে এসে আন্ডার সেক্রেটারী মারিয়া অথেরোর হাতে বটানো একটি কাগজ দিয়ে চলে যান। প্রায় আধা ঘন্টারও বেশি সময় ধরে প্রতিনিধি দল পায়ে হেঁটে রোহিঙ্গা বস্তি ও শিবির পরিদর্শন করেন। দুপুর ১২ টা ৪০ মিনিটে কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সাথে মতবিনিময় করেন। এ সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চায়। উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এসএম শাহ আলম প্রতিনিধি দলকে অবহিত করেন, রোহিঙ্গারা এই এলাকার বনাঞ্চল দখল করে বসতি স্থাপন করছে, গাছ-পালা ধ্বংস ও পাহাড় কাটছে। তাদের কারনে আদম পাচার, চুরি, ডাকাতি, দেহ ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, জালনোট তৈরী সহ বিভিন্ন অপরাধ বাড়ছে। সুতরাং প্রত্যাবাসন কার্যক্রম দ্রুত চালু না করলে আগামীতে রোহিঙ্গাদের সাথে স্থানীয়দের মধ্যে ভয়াবহ সংঘাতের আশংকা দেখা দিয়েছে। এর উত্তরে মারিয়া অথেরো প্রশ্ন করেন,রোহিঙ্গাদের সাথে স্থানীয় বা জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে এ ব্যাপারে আলোচনা বা বৈঠক হয় কিনা ? এ প্রসঙ্গে এসএম শাহ আলম বলেন, এ রকম কোন আলোচনার সুযোগ হয় না। আবার এ রকম বৈঠক বা আলোচনা হলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আরও বাড়বে। মারিয়া অথেরো প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বুঝানোর জন্য রোহিঙ্গাদের সাথে আলোচনার পরামর্শ দেন। রোহিঙ্গা শিবির থেকে যাওয়ার পথে কুতুপালং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে নির্মিত মাল্টি পারপাস সাইক্লোন সেল্টার পরিদর্শন করেন। এ সময় উক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সাথে মতবিনিময় করেন। মারিয়া অথেরো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও পড়ালেখার মান সম্পর্কে খোঁজ নেন। পরিচালনা কমিটির সদস্য সাংবাদিক নুরুল হক খান ও প্রধান শিক্ষক জুম জুম নাহার বিদ্যালয়ের সার্বিক বিষয়ে তুলে ধরেন। এ সময় প্রতিনিধি দলের সাথে ছিলেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ রুহুল আমিন, কক্সবাজারস্থ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার (আরআরসি) ফিরোজ সালাহ উদ্দিন, কক্সবাজার পুলিশ সুপার আজাদ মিয়া, ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ প্রতিনিধি সেন্ট্রাল ক্রেক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) নুরুল বাসির, অতিরিক্তি পুলিশ সুপার ছত্রধর ত্রিপুরা, উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সাইফুল ইসলাম, উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ অপ্পেলা রাজু নাহা, তদন্ত নীলু কান্তি বড়–য়া, রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী। কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জ জালাল উদ্দিন জানান, উক্ত প্রতিনিধি দল ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে শিবিরের চলমান বিভিন্ন কার্যক্রমের খোজঁ খবর নেন এবং সন্তোষ প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য আগামী ১৯ নভেম্বর সদ্য পুন:নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মিয়ানমার সফরের কথা রয়েছে। তার সফর উপলক্ষে মার্কিন দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারী মারিয়া অথেরোর নেতৃত্বে ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল কুতুপালং শরণার্থী শিবির ও রোহিঙ্গা বস্তির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে এই পরিদর্শন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, দীর্ঘ প্রায় ৪ দশক পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মিয়ানমার সফরে এ সমস্যার সমাধানের আলোর মূখ দেখবে।
Leave a Reply