-সাইফুল ইসলাম :
১৭৫৭ সালে এ দেশের স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যাওয়ার পর অধিকাংশ মুসলিম নাখোশ হলেও কিছু মানুষ খুশি হয়েছিল। আবার সেই অস্তমিত সূর্য পুনরায় ১৯৪৭ সালে উদিত হলে অধিকাংশ মুসলিম খুশি হলেও কিছু মানুষ নাখোশ হয়েছিল। কিন্তু ইসলামের নামে অর্জিত স্বাধীনতাকে কিছু নামধারী মুসলিম কলংকিত করলে ১৯৭১ সালে পুনরায় স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় জালেমদের কাছ থেকে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। সে স্বাধীনতার রাজনৈতিক ঘোষণা দেন ৭ই মার্চ বাংলাদেশী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় এবং সামরিক ঘোষণা দেন ২৬ মার্চ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জনক জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে।
“চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসার নাম তো আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশের ক্বওমী মাদ্রাসাগুলির মাঝে আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা হল চট্রগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসা। ২৬ মার্চ, ১৯৭১-এর ভয়াল রাত। মেজর জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। হানাদার বাহিনীর গোলাগুলি শুরু হলে নিরাপত্তার কথা ভেবে মেজর জিয়া বেতারের যন্ত্রপাতি এবং সৈন্যদের ট্রাকে নিয়ে সরাসরি পটিয়া মাদরাসায় চলে আসেন। এখানে এসেও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি রাতে অত্র জামিয়ার মেহমানখানায় অবস্থান করেন। মেজর জিয়াউর রহমানকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে পটিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম আল্লামা দানেশ রহমাতুল্লাহ আলিইহি-কে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদ উনার “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” গ্রন্থের ৫৪, ৫৫ ও ১০২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- হানাদার বাহিনী যখন চট্টগ্রাম শহরে আসল আমরা তখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটার ও অন্যান্য বেতার যন্ত্রপাতি নিয়ে পটিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের সাথে তখন ছিল মেজর জিয়া। কর্ণফুলি নদী পার হয়ে পটিয়ার মাটিতে পারা দিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান চিন্তা করছিল কোথায় তিনি আশ্রয় নিবেন। সেই সময় পটিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম ছিলেন মুহাদ্দেস আল্লামা দানেশ রহমাতুল্লাহ আলাইহি। উনিই জিয়াউর রহমানকে উনার মাদ্রাসায় আমন্ত্রন জানান। যুদ্ধের কারনে মাদ্রাসা ছুটি ছিল। মেজর জিয়াউর রহমান ১ সপ্তাহ পটিয়া মাদ্রাসায় ছিলেন। ১ সপ্তাহ পর তিনি পটিয়া মাদ্রাসা ত্যাগ করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোয়েন্দা আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের মারফত তথ্য পেয়ে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি যে পটিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম মুহাদ্দেস আল্লামা দানেশ ও অন্যান্য শিক্ষকরা জিয়াউর রহমানকে আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিশ্চিত হয় যে পটিয়া মাদ্রাসার সম্মানিত আলেমরা মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেছে তখন ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পটিয়া মাদ্রাসার উপর জঙ্গি বিমান দিয়ে বোমা বর্ষন শুরু করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এই বোমা বর্ষনে পটিয়া মাদ্রাসার সম্মানিত মুহতামিম মুহাদ্দেস আল্লামা দানেশ রহমাতুল্লাহ আলাইহি ও পটিয়া মাদ্রাসার ক্বারী জেবুল হাসানের একজন মেহমান শহীদ হন এবং আরো অনেক সম্মানিত শিক্ষক গুরুতর আহত হন। মেজর জিয়াউর রহমান প্রায়ই এ পটিয়া মাদ্রাসার কথা বিশেষ করে আল্লামা দানেশ রহমাতুল্লাহ আলাইহির কথা বলতেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যে এ পটিয়া মাদ্রাসার বিশেষ অবদান আছে, পটিয়া মাদ্রাসার সম্মানিত শিক্ষক মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহর কাছে যে মুক্তিযোদ্ধারা এসে দোয়া নিয়ে যেতেন, তিনি যে ১৯৭১ সালে স্পষ্ট ফতোয়া দিয়েছিলেন “আমরা মজলুম আর পাকিস্তানিরা জালেম, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা ফরয” এ তথ্য এখনকার কয় জন ছেলে জানে? আমরা শুধু জানি যে রাজাকার আল-বদর আল-শামস এ সব বাহিনীর লোকেরা ইসলামের নাম ব্যবহার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছে, পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ধর্ষনকে সমর্থন করেছে। কিন্তু আমাদের দেওবন্দী কওমি মাদ্রাসার সম্মানিত আলেমরা যে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল, অনেক আলেম যে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল, এ তথ্য আমরা কজন জানি?” -(নেট থেকে সংগৃহিত)
সুতারাং মুক্তিযুদ্ধের সাথে ইসলামের কোন বিরোধ ছিলনা এবং মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের, বিশেষত কওমী আলেমদের অবদানকে অস্বীকার করারও কোন সুযোগ নেই। কিন্তু যখন দেখা গেল স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও ইসলাম ও আলেমদেরকে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিিহ্নত করে প্রতিনিয়ত হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে তখন বাংলাদেশের প্রথম ও ছাত্র সংখ্যার দিক থেকে সর্ববৃহৎ কওমী মাদরাসা “জামিয়া আহলিয়া মঈনুল ইসলাম” হাটহাজারী মাদরাসার সম্মানিত মুহতামিম আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেবের নেতৃত্বে অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ধর্মপ্রিয় সাধারণ জনতা রাস্তায় নামতে বাধ্য হন। বাংলাদেশে ইসলাম না থাকলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে মিশে যেতে আর কোন বাধা থাকে না। তাই একমাত্র ইসলামই বাংলাদেশকে হেফাজত করতে পারে, অন্য কেউ নয়। তার প্রমান হেফাজতে ইসলামের ৬ এপ্রিলের লংমার্চ ও ৮ এপ্রিলের হরতাল। এত বাধার মুখে এতবড় মহাসমাবেশ ও এত কড়া হরতালের মধ্যেও প্রতিপক্ষের কিছু বাড়াবাড়ি ছাড়া হেফাজতকর্মীদের পক্ষ থেকে কোন হতাহত বা ভাংচুরের ঘটনা ঘটেনি। এর কারণ ইসলাম। যে যত বেশি ইসলাম মানে তার কাছে দেশ ও জাতি তত বেশি নিরাপদ থাকবে। তাই হেফাজতে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের হেফাজতের জন্যেই দরকার ইসলামের হেফাজত বা হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবী সরকার বিশ্ববাসীকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের লক্ষ্য থাকবে, বিশ্ববাসীর কাছে হেফাজতকে মৌলবাদী ধর্মান্ধ মধ্যযুগীয় নারীবিদ্বেষী জঙ্গী স্বাধীনতা বিরোধী ইত্যাদি হিসেবে প্রমান করা। সে জন্য তাদের অনুবাদ হবে বিদ্বেষপূর্ণ। তাই হেফাজতের দাবীগুলো যথাসম্ভব প্রত্যেক ভাষায় অনুবাদ করে যুক্তিপ্রমানসহ তুলে ধরা সামর্থবান প্রত্যেকের জন্য ফরজ মনে করতে হবে।
এখন চলছে আস্তিক ও নাস্তিকের যুদ্ধ। এতে যারা খালেছ নিয়তে শহীদ হবে তারা হবে শহীদে হাকীকী বা প্রকৃত শহীদ। সকল ক্ষেত্রে ইসলামী আইন ও বিচার বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবে ইনশাআল্লাহ। যেহেতু সৃষ্টিকে কষ্ট দিয়ে স্রষ্টার সন্তুষ্টি আশা করা যায় না, তাই লংমার্চ পরবর্তী মহাসমাবেশ থেকে লাগাতার অবস্থান বা হরতাল না দিয়ে ভাল করেছে। আগামীতে ঢাকার সচিবালয়সহ ৬৪ জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে স্থায়ী ইসলামী মঞ্চ স্থাপনের ঘোষণা দেয়া হোক। আলেমদের মধ্যেও কেউ কেউ জামায়াত নিষিদ্ধের দাবী করতে পারে। এর ফলে নতুন নামে জামায়াতের আত্মপ্রকাশ তরান্বিত হলে জামায়াত ও দেশবাসী সকলেই লাভবান হবে। তবে নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করার ব্যাপারে সবার সতর্ক থাকা উচিত। আমাদের প্রত্যেককে আল্লাহর রাস্তায় কবুল করুন, আমীন।
হেফাজতে ইসলামের ডাকে অনুষ্ঠিত ৬ এপ্রিল ঐতিহাসিক লংমার্চের ব্যাপক সাফল্যে যার সর্বাধিক সহযোগিতা ছিল তিনি হলেন আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমূদুর রহমান। ১১ এপ্রিল’২০১৩ সকাল ৯টায় তাকে পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করে ১৩ দিনের রিমান্ড দেয়া হয়। তিনি হলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সর্বাধিক প্রভাবশালী লেখক। তার গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে হেফাজতে বাংলাদেশের আন্দোলন শুরু হবে ইনশাআল্লাহ। তবে এ আন্দোলন হতে হবে কারো জানমালের ক্ষতি না করেই। প্রত্যেক জাগায় জাগায় ১৩ জনের কমিটি গঠন করুন যারা ধ্বংশ নয় বরং সৃষ্টির মাধ্যমেই জনমত গঠন করবেন। এতে প্রত্যেকেই বিষয় ভিত্তিক সম্পাদক হবেন। যথাক্রমে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, বিবাহ, নিরাপত্তা, ন্যায় বিচার, ধর্ম, প্রযুক্তি, অর্থ, সমন্বয়। আমরা হেফাজতে ইসলামের ১৩ দাবীর সঙ্গে সম্পাদক মাহমূদুর রহমান ও আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তি দাবী করছি। আল্লাহ আমাদেরকে, আমাদের দেশ জাতি ও ধর্মকে হেফাজত করুন, আমীন।
লেখক- সাইফুল ইসলাম, আহবায়কঃ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলিম ঐক্য পরিষদ ও বেসরকারী মাদরাসা শিক্ষক পরিষদ।