টেকনাফ নিউজ ডেস্ক:::বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শাহপরীরদ্বীপের ভূখন্ড। টেকনাফের উপকূলীয় ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এ অবস্থায় সীমান্ত জনপদ টেকনাফের ৩ লক্ষাধিক উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা চরম আতংকে দিন কাটাচ্ছে।ভগ্নদশার কারণে কয়েক হাজার একর জমিতে আমন ধান চাষাবাদ, লবণ চাষ করা সম্ভব হয়নি। বিধ্বস্থ বেড়িবাঁধের কারণে মৎস্য খামারী ও চিংড়ি চাষীদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ওই বেড়িবাঁধ নির্মাণে বর্তমানে ১৮০ কোটি টাকার প্রয়োজন বলে জানা গেছে।সম্প্রতি শাহপরীরদ্বীপ ক্যাম্প পাড়া, উত্তর পাড়া আংশিক, গোলা পাড়া, মাঝরপাড়া, দক্ষিণপাড়া ও পশ্চিমপাড়ায় ব্যপক ভাঙ্গন ধরে প্রায় হাজারখানিক বসতবাড়ি জায়গা থেকে হারিয়ে গেছে। টেকনাফের উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারীদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে অনেকটা বেড়িবাঁধের উপর। তবে বিধ্বস্থ হওয়ায় ক্ষতির মাত্রা দিন দিন বাড়ছে।
বিশেষতঃ শাহপরীরদ্বীপে বেড়িবাঁধের ভয়াবহ ভাঙ্গণে বিশাল এলাকা ইতিমধ্যেই সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। জমি হারা, বসতভিটা হারা হয়েছে অনেক পরিবার। ভাঙ্গণ এখনও অব্যাহত রয়েছে।
সরেজমিন পরিদর্শন কালে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, যথাসময়ে কাজ না করা, কাজে কারচুপি ও বাঁধ পুন:নির্মাণ অনিয়ম এবং মেরামতে ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন ইত্যাদি কারণে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধ টেকসই হয়নি। টেকনাফ উপজেলায় ৪টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভা উপকূলীয় বেড়ীবাঁধের আওতাভূক্ত।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং, হ্নীলা, টেকনাফ সদরের কিছু অংশ, টেকনাফ পৌরসভা এবং সাবরাং শাহপরীরদ্বীপ হয়ে কাটাবনিয়া পর্যন্ত ৪টি ফোল্ডারে ৬০.৭ কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ রয়েছে। তা হচ্ছে- ৬৮ নং ফোল্ডার ২৭ কিলোমিটার, ৬৭/বি নং ফোল্ডার ৮কিলোমিটার, ৬৭নং ফোল্ডার ১২.৭ কিলোমিটার, ৬৭/এ নং ফোল্ডার ১৩ কিলোমিটার। ফোল্ডারের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে বেড়িবাঁধ বিধ্বস্থ হয়েছে ৬৮নং ফোল্ডারে।
এ বিষয়ে প্রতিবারই টেকনাফ উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় উত্থাপিত ও দাখিলকৃত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদনে বলা হয় ৬৮ নং ফোল্ডারের ১৬.১০০ হতে ১৬.৪০০ পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার, ১৫.১৬০ হতে ১৫.৮৬০ পর্যন্ত ৭কিলোমিটার এবং ১৫.১৬০ হতে ১৬.৭৩৩ পর্যন্ত ১.৫৭৩ কিলোমিটার সম্পূর্ণ বিধ্বস্থ হয়েছে। তাছাড়া ৬৮ নং ফোল্ডারের ৬ কিলোমিটার, ৬৭/বি নং ফোল্ডারের ৪কিলোমিটার, ৬৭নং ফোল্ডারের ৫কিলোমিটার, ৬৭/এ ফোল্ডারের ১১.৯০০কিলোমিটার মোট ২৬.৯০০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ বর্ষা শেষে জরুরি ভিত্তিতে মেরামতের প্রস্তাব করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে শাহপরীরদ্বীপের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্থ হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিভিন্ন প্রতিনিধি দল ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ডিজাইন সেল এর টিম একাধিকবার শাহপরীরদ্বীপ বিধ্বস্থ বেড়িবাঁধ সরেজমিন পরিদর্শণ করেছে। ডিজাইন সেল এর কারিগরি টিম শুধু শাহপরীরদ্বীপের ভাঙ্গা অংশের বাঁধ টেকসই ভাবে পুন:নির্মাণে ১২০ কোটি টাকার প্রাক্কলন তৈরি করে গতবছর সংশ্লিষ্ট দপ্তর সমূহে দাখিল করেছে। তাছাড়া বাকি ফোল্ডার সমূহের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ টেকসই ভাবে মেরামত করতে ব্লকসহ আরও কমপক্ষে ৬০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ শফিক মিয়া জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মান্ধাতা আমলের ডিজাইন নিয়ে কাজ করলে বাঁধ মোটেও টেকসই হবে না। এতে দেশি-বিদেশী অর্থের অপচয় ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হবে না। সরেজমিন বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা যাচাই করে বিশেষজ্ঞ কারিগরী কমিটি গঠন করে যথাযথ ডিজাইনের মাধ্যমে কাজ করতে তিনি সরকারের প্রতি দাবি জানান।
উপকূলীয় এলাকাবাসী এ ব্যাপারে বর্তমান সরকার দলীয় এমপি আব্দুর রহমান বদির নজরদারী উদ্যোগ ও হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। এদিকে টেকনাফের মৎস্য জোন খ্যাত শাহপরীরদ্বীপের ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ নির্মাণ, শাহপরীরদ্বীপ-টেকনাফ সড়কের সংস্কার, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের দাবিতে শাহপরীরদ্বীপ রক্ষা ও উন্নয়ন পরিষদ ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে ও কোন সুরাহা হয়নি। তাদের দাবিকৃত শাহপরীরদ্বীপের পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়া হয়ে জালিয়াপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বেড়িবাঁধের পাশে পতেঙ্গা সৈকতের মত বড় বড় সিসি ব্লক স্থাপন, স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে সেনা বাহিনীর তত্বাবধান নিশ্চিত করণ, ১০ বছরে ক্ষতিগ্রস্থ ও বিলীন ঘরবাড়ির মালিককে ক্ষতিপূরণ প্রদান অথবা পূর্ণবাসন, ক্ষতিগ্রস্থদের মাথা গুজার ঠাই হিসাবে খাস জমি বন্দোবস্তি প্রদান, বেড়িবাঁধ রক্ষার জন্য বাঁধের পাশে সবুজ বেষ্টনী অথবা বনায়ন সৃজন, ঘুর্ণিঝড় থেকে রক্ষার জন্য শাহপরীরদ্বীপে আরো ৫টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ,‘টেকনাফ-শাহপরীরদ্বীপ’ ভাঙ্গা সড়কের দ্রুত সংস্কার এবং সড়কের উচ্চতা আরো তিন ফুট উঁচু করণ।
৯ নং ওয়ার্ডের আব্দুস সালাম মেম্বার জানান, বড় বাঁধ পুনঃনির্মাণ না করায় সদ্য সমাপ্ত লবণ মৌসুমে প্রায় ২’শ কোটি টাকার লবণ উৎপাদন থেকে চাষীরা বঞ্চিত হয়েছে। তাছাড়া শাহপরীরদ্বীপ করিডোর দিয়ে মিয়ানমার থেকে আমদানী করা গবাদি পশু সড়ক বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে পরিবহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ সরকার গবাদি পশু আমদানী হতে বছরে ৩ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে থাকে। জরুরি ভিত্তিতে শাহপরীরদ্বীপ বেড়িবাঁধের ভাঙ্গা অংশ পুন:নির্মাণ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে শাহপরীরদ্বীপ ঘোলার চরের মত বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।