বৃহস্পতিবার পবিত্র শবে বরাত। আল্লাহ প্রেমিক মুসলমানদের জন্য অনেক আশা ও ভরসার রাত এটি। এই একটি রাতের জন্য আশায় বুক বেধে থাকেন আল্লাহর কতো অসহায় ও দুঃখী বান্দা! আমাদের জীবনের সবকিছু যাঁর ইশারায় চলে তিনি তো সেই পরম শক্তিমান আল্লাহ। তাঁর কাছে নিজের সব সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার ফরিয়াদ জানিয়ে কেঁদে কেটে নিজেদের দীনহীন ভাগ্য উন্নয়নে একটু দয়া ও করুণা ভিক্ষা করার এমন সুবর্ণ সুযোগ সব সময় আসে না।শবে বরাত এমনই এক মহামূল্যবান সুযোগ। আরবি শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিনগত রাতই হচ্ছে শবে বরাত বা নাজাতের রাত। দুর্ভাগা ছাড়া আর কেউ এ রাতের কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হতে পারে না। এ রাতের পুরোটা সময়জুড়ে আমাদের জন্য আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমত ও তাওয়াজ্জুহের দুয়ার খোলা থাকবে। কাজেই হেলায় খেলায় যেন তা পার হয়ে না যায়।আল্লাহ পাক আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তিনি তাঁর সৃষ্ট জীব মানুষকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। অথচ আমরা নিজেদের অপরাধ ও অবাধ্যতায় ডুবে গিয়ে তাঁকে ভুলে থাকি সারাটা বছর। দয়াময় আল্লাহ তবুও আমাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকেন। যে মানুষকে তিনি সাজিয়েছেন আপন হাতে, যাকে ভালোবেসে দিয়েছেন এ পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব, সেই মানুষকে পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁর দিকে ডাকছেন এভাবে- ÔÔওহে মানুষ, তোমাদের এমন দয়াময় ও দয়ালু রবের কাছে ফিরে আসা থেকে কে তোমাদের ধোঁকা দিয়ে সরিয়ে রাখছে?ÕÕ (সূরা ইনফিতারের ৬ নম্বর আয়াত)এক হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাক বান্দাদের অভয় দিয়ে বলেছেন, ‘‘তুমি যদি এ আকাশ ও মাটিভরা গুনাহ নিয়ে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করো এবং আমাকে ডাকো ক্ষমা চাও, আমি তোমার সব গুনাহ মাফ করে দেবো, এতে আমি কাউকেই পরোয়া করি না।’’
পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাকে বারবার তওবা করতে বলেছেন, শয়তানের ধোঁকা থেকে সতর্ক করেছেন।
স্বার্থপরতার এ পৃথিবীতে লোভ ও হিংসার জালে বন্দি হয়ে আমরা এসব ভুলে যাই বারবার। তবুও তিনি সুযোগ দিয়ে চলেছেন অবিরাম, এই বুঝি তাঁর কোনো বান্দা তাঁর কাছে সত্যিই ফিরে আসবে, তাঁকে ডাকবে।
এ পবিত্র ও মহিমান্বিত রজনীর পূর্ণ বরকত ও সাফল্য পেতে হলে কয়েকটি বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। পবিত্র এ রাতের ভাবগাম্ভীর্য যেন নষ্ট না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
এ বরকতময় রাতে আমাদের আত্মীয়-স্বজন অথবা কোনো বন্ধু যেন আতশবাজি কিংবা রুটি হালুয়ার উৎসবে মেতে না ওঠে, দল বেঁধে শহর ভ্রমণ কিংবা অন্য কোনো অনর্থক কাজে জড়িয়ে না পড়ে- সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদেরই।
ইসলাম কেবল স্বার্থপরের মতো নিজেকে ইবাদতে লিপ্ত হতে বলেনি, বরং অন্যকে ডাকা ও বোঝানোর দায়িত্বও দিয়েছে আমাদের।
আর একটি কথা মনে রাখতে হবে, শবে বরাতের কোনো নির্দিষ্ট সালাত কিংবা আমলের কথা কুরআন ও হাদীসের কোথাও নেই। আপনি যেভাবে ভালোবাসেন সেভাবেই আল্লাহকে ডাকুন। কারণ এ রাত একান্তই আপনার।
আপন স্রষ্টার কাছে নির্জনে প্রাণখুলে নিবেদন করুন নিজের সব চাওয়া পাওয়ার কথা। দুঃখ ও বেদনা এবং কষ্ট ও ভালোবাসার সব আর্তি ও ফরিয়াদ তাকে জানান নিঃসঙ্কোচে, তিনিই তো পরম আপন আমাদের, যার কাছে না চাইলে তিনি অসন্তুষ্ট হন।
তাই এ রাতে সালাত কিংবা শুধু তিলাওয়াত অথবা যিকির, যেভাবে আপনি ভালোবাসেন এবং যা আপনি নিজে শুদ্ধভাবে করতে জানেন, সেটুকুই করুন। পরম করুণাময় তো আপনার অন্তর পর্যবেক্ষণ করছেন, কতো রাকাত সালাত আদায় করছেন কিংবা কতো টাকা দান করছেন, সেটি তাঁর কাছে বিবেচ্য নয়।
বেশ কয়েকটি হাদীসের গ্রন্থে বর্ণিত এক হাদীসে রাসুল (সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এ রাতে দুই শ্রেণির লোকের ডাকে আল্লাহ পাক সাড়া দেন না- এক. মুশরিক যে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করে এবং দুই. ওই মুসলমান যার সাথে অন্য কোনো মুসলমানের ঝগড়া বিবাদ রয়েছে এবং তারা দুজন পরস্পর সম্পর্কহীন, এ দু’জন নিজেদের বিবাদ না মেটানো পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাদের প্রার্থনাকে অপেক্ষার তালিকায় রেখে দেন।
বর্তমানে এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কর্মস্থল কিংবা পাড়া মহল্লা অথবা আত্মীয়-স্বজনের কারো সাথে হয়তো আপনার দ্বন্দ্ব হয়েছে তাই আপনারা একে অপরের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ করে দিয়েছেন। বিষয়টি সমাজের দৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও মহান আল্লাহর কাছে মোটেও তুচ্ছ নয়। তাই বিবদমান এমন দু’জনের দোয়া তিনি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। অপেক্ষায় থাকেন, কবে তার এ দুই বান্দা সব বিবাদ ভুলে বুকে বুক মিলিয়ে একই কাতারে এসে দাঁড়াবে, সেদিনই তিনি তাদের প্রার্থনায় সাড়া দেবেন। নিজের দ্বীন ও দুনিয়ার অসামান্য সফলতা এবং কল্যাণের জন্য এ পৃথিবীর সামান্য স্বার্থের সংঘাত ভুলে গিয়ে আল্লাহর জন্য ওই মানুষটিকে বুকে মিলিয়ে নেওয়াই তো প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ।
রাসুল (সা.) এ রাতে কবরস্থান যিয়ারত করেছেন বলে হাদীসের কয়েকটি কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। আপনিও নিজের মৃত মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন কিংবা কোনো মুসলমানের কবর যিয়ারত করতে পারেন। তাদের আত্মার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং কিছু সওয়াব তাদের নামে উৎসর্গ করতে পারেন। মৃতদের জন্য দোয়া করলে আপনার সওয়াবের কোনো কমতি হবে না। কবরবাসী প্রতিটি জীবিত মুসলমানের সামান্য দোয়ার জন্য চাতকের মতো তাকিয়ে থাকেন পিপাসার্ত হয়ে।
ভুলে যাবেন না, মহান আল্লাহ পাক এ রাতের সমগ্র প্রহরজুড়ে বান্দাদের দিকে তার রহমতের দৃষ্টি দিয়ে থাকেন। মানুষের চাওয়া ও প্রার্থনাগুলো তিনি গ্রহণ করেন, তাই একাগ্র চিত্তে সমর্পিত প্রাণে আল্লাহকে ডাকুন, তাঁর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করুন।
রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ পাক কোনো উদাসীন হৃদয়ের প্রার্থনা কবুল করেন না। তাই তাঁর অসীম দয়া ও অপরিসীম শক্তির ওপর পূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাস রেখে জীবনের সব প্রয়োজন তাকেই খুলে বলুন। কারো মাধ্যমে নয়, সরাসরি তিনি আপনাকে দেখছেন ও শুনছেন, তাই নিজেই নিজের চাওয়া আল্লাহর কাছে পেশ করুন।
চারিদিকে নিরাশা ও বিপদের এ কঠিন সময়ে বারবার অনুভূত হচ্ছে আল্লাহকে ডাকার ও তার কাছে আত্মসমর্পণের প্রয়োজনীয়তা। তিনি ছাড়া তো আমাদের আর কোনো সহায় নেই। শক্তি কিংবা বুদ্ধি দিয়ে নয়, তার সামান্য দয়া বর্ষণে ভেসে যাবে আমাদের সব মনোবেদনা ও জীর্ণতা।
পবিত্র শবে বরাতের এ কল্যাণময় প্রহরে আমাদের এটুকু আত্মোপলদ্ধিই হতে পারে নির্মল ও আলোকিত জীবনের নতুন সূর্যোদয়।
Leave a Reply