টেকনাফ নিউজ ডেস্ক *** সকল অর্জনই বিফলে যাবে, যদি বালি দিয়ে নির্মিত ক্রসবার (বালির বাঁধ) টিকিয়ে রাখা না যায়। এই বর্ষায় প্রচ- ঝুঁকির মুখে রয়েছে সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টের উজানে ও ভাটিতে নির্মিত চারটি ক্রসবারই। পাইলট ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় যমুনা নদী খনন করা বালি দিয়ে এই ক্রসবার নির্মাণ করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই পুনরুদ্ধার করা হয় বর্তমান বাজার দরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ভূমি। আরও আড়াই হাজার কোটি টাকার ভূমি পুনরুদ্ধার হবে এই বর্ষা পাড়ি দিতে পারলেই। এমন আশা জাগানিয়া প্রকল্পটি টিকাতে জরুরী ভিত্তিতে অস্থায়ী কাজের জন্য প্রয়োজন ২৪ কোটি টাকা। আর স্থায়ীভাবে ক্রসবার চারটি রক্ষায় প্রয়োজন ২৫৪ কোটি টাকা। এজন্য রিভাইজ ডিপিপি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। পাইলট ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় যমুনা নদী খননের জন্য মূল ডিপিপি’তে এক হাজার ২৮ কোটি টাকা থাকলেও রিভাইজ ডিপিপি’তে এটি কমিয়ে এক হাজার ২২ কোটি টাকা করা হয়েছে। ক্রসবার নির্মাণ ও এর রক্ষণাবেক্ষণের সমুদয় অর্থ ধরেই এই রিভাইজ ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার একনেকের বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে, ভয়াবহ হুমকির মুখে রয়েছে দেশের ঊনিশটি জেলার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও পোল্ডার সমূহ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সমুদ্রে পানির তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়া, ঘন ঘন জলোচ্ছ্বাস, জোয়ারের পানির ব্যাপকতা এবং পানির থারমাল ওয়ার্মিং (পানির উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া) এর কারণে এই হুমকি দেখা দিয়েছে। এর ফলে আগামী ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে উপকূলীয় এলাকার ৫ হাজার ৭শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের পুরোটাই ডুবে যাবে। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এসব জেলার ১৩৯টি পোল্ডারের সবগুলোই। এসব পোল্ডারের ভেতর রয়েছে কমপক্ষে ১২ লাখ হেক্টর জমি। এই অবস্থার উত্তোরণে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া না হলে জানমাল সহ সম্পদ ও ফসলের অপূরনীয় ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা বাড়তেই থাকবে। এ জন্য উপকূলীয় এলাকার পুরো বেড়িবাঁধই বর্তমান উচ্চতা থেকে কমপক্ষে আরও ২ মিটার পর্যন্ত উঁচু করতে হবে। উপকূলীয় এলাকার উপর পরিচালিত সমীক্ষায় বিশ্ব ব্যাংক ও নেদারল্যান্ড এমন মতামতই দিয়েছে। এ জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা।
জানা যায়, ১৯৬০ সালে আইকো’র নির্মিত এই বেড়িবাঁধ ও পোল্ডারের স্থায়িত্বের মেয়াদ ২০ বছর আগেই শেষ হয়েছে। এখন কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে মেরামতের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চলছে। পাউবো সূত্রে জানা গেছে, কোষ্টাল এ্যামবাঙ্কমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আতওতায় বিশ্ব ব্যাংক ১৭টি পোল্ডার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। আর ‘ব্লু গোল্ড’ নামক প্রকল্পের আওতায় নেদারল্যান্ড উপকূলীয় এলাকায় আংশিক বেড়িবাঁধ উচুঁ করার কাজ করছে।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের পক্ষে উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ নতুন করে নির্মাণ সম্ভব নয়। এই কর্মকর্তার মতে, নতুন করে বেড়িবাঁধ নির্মাণে প্রচুর অর্থেও প্রয়োজন। যা সরকারের পক্ষে জোগান দেয়া অনেক কঠিন। এমনিতেই ব্যাপক অর্থ সঙ্কটে ধুঁকছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। ফলে পাউবো’র পক্ষে উন্নয়ন কাজতো দূরের কথা, মেরামত কাজই ঠিকভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। জানা যায়, গত তিন বছর যাবত মেরামত মঞ্জুরি বাবদ যে ৩শ’কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, তারও সিংহভাগ মেরামত কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছেনা। এ ব্যপারে পাউবো’র একটি সূত্র জানায়, মেরামত মঞ্জুরির মাত্র ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা মেরামত কাজে ব্যবহার করা যায়। বাকি টাকা মন্ত্রী, এমপিদের চাপে নতুন প্রকল্পে ব্যয় করা হয়। এমন দূরাবস্থার মধ্যেই চলছে পাউবো। জরুরিভাবে মেরামত মঞ্জুরি বৃদ্ধি করা না হলে এই বর্ষায় উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার নদী ভাঙন প্রতিরোধ কার্যক্রম চালিয়ে নেয়াটা পাউবো’র পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এ নিয়ে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বেন পাউবো’র মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন ইনকিলাবকে বলেছেন, দেশের নদী ভাঙন প্রতিরোধ এবং উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজতো আর বন্ধ রাখা যাবে না। তিনি বলেন, অর্থ সঙ্কটতো রয়েছেই। তাই বলে উন্নয়ন ও মেরামত কাজ থেমে নেই। সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টের উজানে ও ভাটিতে নির্মিত চারটি ক্রসবার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রকল্পের রিভাইজ ডিপিপি অনুমোদন না হলে সকল অর্জনই বিফলে যাবে। বর্ষায় ক্রসবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুনরুদ্ধারকৃত ভূমির ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে। সমুদয় ভূমি চলে যাবে পুনরায় নদীগর্ভে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মো. আজিজুল হক বলেছেন, চারটি ক্রসবার স্থায়ীভাবে রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হলে ঝুঁকিমুক্ত হবে বঙ্গবন্ধু সেতু। এছাড়াও ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট এবং প্রস্তাবিত শিল্প পার্ক এলাকা।
জানা যায়, ক্যপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে দেশের নদ-নদীর নব্যতা রক্ষা ও নদী থেকে ভূমি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা দিয়েছেন তারই আলোকে এই পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় যমুনায় সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর ভাটিতে নিউ ধলেশ্বরী অফটেক পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার এবং নলীনে ২ কিলোমিটার মোট ২৪ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হয়। এর মধ্যে ১৪ কিলোমিটার ড্রেজিং করে চীনের প্রতিষ্ঠান হারবার কোম্পানী। বাকি খনন কাজ করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। মূলত চায়না হারবার কোম্পানীর খননকৃত বালি দিয়েই এই চারটি ক্রসবার নির্মাণ করা হয়েছে। এ জন্য চীনা প্রতিষ্ঠানটিকে অতিরিক্ত কোন অর্থ দিতে হয়নি। বরং এই ক্রসবার নির্মাণের মাধ্যমে নদী থেকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে ভূমি। এদিকে, এখানকার পরীক্ষামূলক প্রকল্পের এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের অন্যান্য নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হবে। দেশের মোট ৪০৫টি নদীর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ২৩টি নদীকে এই প্রকল্পের আওতায় নেয়া হবে। এ জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর ক্যাপিটাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে ১৫ থেকে ২০ বছর। অনেকেই একে অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হিসাবে দেখছে। সমালোচকদের মতে, এত বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্বলিত এমন প্রকল্প আদৌ বাস্তবায়নযোগ্য নয়। তবে দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকল্পটি দেশের স্বার্থেই বাস্তবায়ন হওয়া উচিত।
চারটি ক্রসবার নির্মাণের ফলে পুনরুদ্ধারকৃত ভূমির পরিমাণ ১৬ স্কয়ার বর্গ কিলোমিটার। জানা যায়, পুনরুদ্ধারকৃত এই ভূমিতে চলতি বছর প্রায় ৮০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ধান, আলূ, বাদাম, তিল, তরমুজ ও বিভিন্ন ধরণের সজ্বী। সেইসাথে ড্রেজিংয়ের কারণে যমুনার মূল স্রোতধারা পরিবর্তন হওয়ায় ভাঙ্গনকবলিত এলাকায় পলি পড়ছে। তবে স্থায়ীভাবে এই চারটি ক্রসবার রক্ষা করা গেলে আরও ভূমি পুনরাদ্ধার সম্ভব এমন মতামত বিশেজ্ঞদের। সেইসাথে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে এখানকার প্রস্তাবিত শিল্প পার্ক এলাকা। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, এতসব অর্জন যে অস্থায়ীভাবে নির্মিত বালুর ক্রসবার দিয়ে-সেই ক্রসবারেই ইতোমধ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যমুনার ভাঙন থেকে ক্রসবার টিকিয়ে রাখতে জিও টেক্সটাইল ফিল্টার দিয়ে সেøাব প্রেেিটকশন দেয়া হচ্ছে। চলছে জিও ব্যাগ ডাম্পিং। তবে এই বর্ষায় ব্যাপক ভাঙন থেকে এসব ক্রসবার রক্ষায় জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
সিরাজগঞ্জ হার্ডপয়েন্ট থেকে উজানে শৈলবাড়ী গ্রোয়েনের মাথায় নির্মাণ করা হয়েছে ১ নম্বর ক্রসবারটি। আর ভাটিতে ৪ নম্বও ক্রসবারটি যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর দূরত্ব মাত্র ১ কিলোমিটার। একেকটি ক্রসবার লম্বায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার। আর চওড়ায় ৫০ থেকে ১শ’ মিটার পর্যন্ত।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ক্রসবার নির্মাণের ফলে সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট নদী ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে। এর ফলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম গাইড বাঁধ নদী ভাঙ্গন কবল থেকে রক্ষা এবং অধিকতর নিরাপদ হয়েছে। যমুনার মূল স্রোতধারা হার্ড পয়েন্ট থেকে পূর্ব দিকে গতি পরিবর্তন করেছে। এতে করে এলাকা রক্ষা পাচ্ছে। রক্ষা পাবে প্রস্তাবিত শিল্পপার্ক এলাকা নদী ভাঙন থেকে। এর ফলে এখানে অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা দিবে। এতে করে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এই ক্রসবারের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার হাজার হাজার মানুষ নদী ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এডিজি মো. আফজাল হোসেন জানান, স্থায়ীভাবে ক্রসবার চারটি রক্ষা করতে পারলে উজানে এবং ভাটিতে আরও ভূমি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তিনি জানান, পশ্চিম তীর ঘেঁষে নদীর তলদেশ গত বছর ছিল ৭শ’ মিটার। এবার নদীর তলদেশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৮শ’ মিটার হয়েছে। এখানে যমুনা নদীর তলদেশের গড় উচ্চতা প্রায় ৮ মিটার উঁচু হয়ে গেছে। তারমতে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় ভাঙনকবলিত এলাকায় পলি পড়ছে। তিনি ক্রসবার রক্ষায় স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক কাজের উপর গুরুত্বারোপ করেন।