সাইফুল ইসলাম সাইফী= প্রায় দুইশ বছর আগে থেকে বসতি শুরু হয় দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমাটিনে। এর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসসহ ভয়াবহ নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগ টেকনাফ উপকুলে আঘাত হানলেও কখনো মনোবল ভাংঙেনি সেন্টমার্টিন-দ্বীপবাসীর।
কিন্তু সম্প্রতি এ দ্বীপে প্রথম বারের মত জলোচ্ছাস আঘাত হানে এবং দ্বীপের চারপাশে ভয়াবহ ভাঙ্গনের সৃষ্ঠি হওয়ায় নতুন করে ভাবনায় পড়েছে দ্বীপের প্রায় আট হাজার বাসিন্দা। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে দিন দিন দ্বীপটি ছোট হয়ে আসায় দেশের মানচিত্র থেকে দ্বীপটি হারিয়ে যাবে এমন আশংকায় উদ্বিগ্ন দ্বীপবাসী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,মৌসুমে সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের অস্বাভাবিক চাপ, শামুক-ঝিনুক ও প্রবাল আহরন,পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত কর্মকান্ড এবং বহুমাত্রিক দূষনের জন্য মূলত দ্বীপটি হুমকীর মুখে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৯১সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়,৯৪’র জলোচ্ছাসসহ কোনো প্রাকৃতিক দূযোর্গের সময় এ দ্বীপে পানি ওঠেনি । ভাঙ্গনের সমস্যাও তেমন একটা ছিলনা। কিন্তু দ্বীপে বসতি শুরুর দীর্ঘ দুইশ বছর পর, এ বছর মে মাসের শেষ সপ্তাহে মাত্র কয়েকদিনের বৃষ্টি আর পূর্ণিমার জোয়ারে হঠাৎ সেন্টমার্টিনে জলোচ্ছাসের সৃষ্ঠি হয়। দ্বীপের চতুর্দিকে ভাঙন শুরু হয়। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে দ্বীপের চারপাশে বিশাল অংশ পানিতে তলিয়ে যায়। প্রথম দিনেই দ্বীপের আটটি বসতঘরসহ প্রায় ২১টি স্থাপনা পানিতে ধ্বসে যায়। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে দ্বীপের উত্তর ও পশ্চিম অংশে অবস্থিত একমাত্র একমাত্র কবরস্থানটির ১৫০ ফুটেরও বেশী সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে গেছে। ফলে শংকিত হয়ে পড়ে দ্বীপের বাসিন্দারা।
সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা গেছে, জোয়ারের পানি আর সমুদ্রের ঢেউয়ের কারণে দ্বীপে চার পাশেই ভাঙ্গনের সৃষ্ঠি হয়েছে। বেশী ভেঙ্গেছে উত্তর-পশ্চিম অংশে। এদিকে বি¯তৃর্ণ কেয়াবন সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। দ্বীপের একমাত্র কবরস্থানটির প্রায় দেড়শ ফুটেরও বেশী সাগরে তলিয়ে গেছে। মাটি সরে যাওয়ায় স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িসহ আশপাশের কয়েকটি সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। দেখা গেল,ভাঙ্গনের কবলে পড়ে কবর থেকে বেরিয়ে আসা একটি মানুষের কংকালও।
এ ছাড়াও দ্বীপে প্রবাল ও শৈবালযুক্ত পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটাচলা, অবাধে প্রবাল, শামুক, ঝিনুক আহরণ, অপরিকল্পিত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার কারণে অব্যাহতভাবে দ্বীপের পানি ও মাটি দূষণ চলছে। প্রাকৃতিক কেয়া বন ও ঝোপঝাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। অবাধ চলাচল এবং প্রাকৃতিক আকার নষ্ট করে নিজেদের মত করে ব্যবহারের কারণে ধ্বংস হচ্ছে বালিয়াড়ি।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান জানান, দ্বীপের দুইশ বছরের ইতিহাসে এ রকম জলোচ্ছাস এবং ভয়াবহ ভাঙ্গন এই প্রথম। তিনি জানান,সেন্টমার্টিন দ্বীপটি উত্তর-দক্ষিণ প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। কিন্তু ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বর্তমানে তিন কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে এবং ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে সেন্টমার্টিন। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে দ্বীপটি হারিয়ে যাবে বর্তমানে এমন আশংকায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে দ্বীপের সাধারণ মানুষ।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুরুল আমিন জানান, এ দ্বীপে মানুষের বসবাস শুরু হয় প্রায় দুইশ বছর আগে। দ্বীপে বসতি শুরুর পর এভাবে কোনো দিন এখানে পানি ওঠেনি । এ রকম ভয়াবহ ভাঙ্গনও কোন সময় দেখা যায়নি । নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাকা স্থাপনা নির্মান এবং নানা ভাবে পরিবেশ দূষনের কারণে এখানে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। তিনি বলেন,আবার শুধু পরিবেশের ক্ষতির কথা বলে কোনো উদ্যেগ না নিয়ে বসে থাকলে এ দ্বীপটি একদিন হারিয়ে যাবে। পরিবেশেরও ক্ষতি যাতে না হয়,দ্বীপটিও রক্ষা হয়,স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সমন্বয় করে সেন্টমার্টিনকে রক্ষার জন্য একটা নীতিমালা করা প্রয়োজন ।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সর্দার শরিফুল ইসলাম বলেন, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নানা কর্মকাণ্ডের প্রভাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি হুমকির মুখে পড়েছে। এখানকার জীব বৈচিত্রও হুমকীর মুখে। এ দ্বীপে অবাধে প্রবাল আহরন,কেয়াবন ধ্বংস,এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং বহুমাত্রিক দূষন বন্ধ এবং শীত মৌসুমে পর্যটকদের আগমন নিয়ন্ত্রণ করা না হলে এ দ্বীপের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, এ দ্বীপের ভার ক্ষমতা খুব কম। মাত্র আট-দশ ফুট গভীরে গেলেই খাবার পানি পাওয়া যায়। দ্বীপ রক্ষায় দ্বীপের মানুষকে আগে সচেতন হতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে এটা পানির উপর একটা ভাসমান জাহাজের মত। এ দ্বীপেরও একটি নিদিষ্ট ভার ক্ষমতা আছে। ভার এর বেশী হলেই দূর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে।
কিন্তু নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এখানে একের পর এক পাকা স্থাপনা হচ্ছে। দ্বীপের রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করে কেয়াবন। কিন্তু হোটেলে বসে সমুদ্র দেখার জন্য কেয়াবনগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে।
জানা গেছে,বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণায় দ্বীপের জন্য ক্ষতিকর পাকা স্থাপনা নির্মানে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা থাকলে এখানে তা মানা হচ্ছেনা।
এ প্রসংগে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সর্দার শরিফুল ইসলাম বলেন,স্থাপনা তৈরীর কথা শুনে কিছুদিন আগে পরিবেশ অধিদপ্তর সেন্টমার্টিনে অভিযান চালান। বাঁধা দিতে গিয়ে সেখানে উল্টো তারা প্রভাবশালীদের বাঁধার মুখে পড়েন।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেন্ট মার্টিনে প্রবাল-শৈবালের বেশির ভাগ প্রজাতিই এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পর্যটকবাহী জাহাজ থেকে নির্গত তেল ও সাগরে ফেলা আবর্জনা এবং জাহাজ চলাচলের কারণে সৃষ্ট কাদা প্রবালস্তরে গিয়ে জমাট বাঁধার কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে প্রবাল। এ ছাড়াও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দ্বীপের বিভিন্ন প্রজাতীর সাপ, গুইসাপ বা সমুদ্র শসা এবং কাছিম আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কাজ বন্ধ এবং অবাধে পর্যটক যাতায়াতে বিধি-