আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং কোন রকমের বৈষম্য ছাড়াই সকলে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।’ সেই সাথে ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ ভেদে অথবা জন্মস্থানের কারণে কারো প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।সংবিধানের ২৭ ধারায় উল্লেখ রয়েছে সব নাগরিক সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী, তবে সংবিধানে বর্ণিত এই সমান অধিকার বা সমান আইনি প্রতিকার পাওয়ার অধিকার শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, বাস্তবতায় রয়েছে ভিন্নতা। অঞ্জলি বিশ্বাসের (ছদ্ম নাম) সাথে দেবাশীষ বিশ্বাসের হিন্দু শাস্ত্রমতে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় নিয়ম ও প্রথা মেনে পূজার বাবা হিরন্ময় বিশ্বাস মেয়ের সুখের জন্য নগদ টাকা, ব্যবহার্য আসবাবপত্র ও স্বর্ণালংকার যৌতুক হিসেবে ছেলেকে প্রদান করেন। কিন্তু বিধিবাম! কয়েক বছর যেতে না যেতেই দেবাশীষ প্রথম স্ত্রী অঞ্জলি বিশ্বাসকে কোনো কিছু না জানিয়ে কিংবা তার অনুমতি ব্যতিরেকে আরেকটি বিয়ে করেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী রানী বিশ্বাসকে (ছদ্ম নাম) নিয়ে সুখে বসবাস শুরু করেন। এদিকে অঞ্জলি বিশ্বাস দীর্ঘদিন ধরে স্বামীর আদর, স্নেহ, ভালবাসা ও ভরণপোষণ থেকে বঞ্চিত হয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবন যাপন করতে থাকেন।
কিন্তু হিন্দু ধর্মের বিধান মতে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিষ্কার বিধান না থাকায় তাকে যে তাদের নিয়মকানুন মেনে চলতে হচ্ছে। হিন্দু আইনে তালাক দেওয়ার কোনো প্রকার বিধান না থাকায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অঞ্জলি বিশ্বাসকে দেবাশীষ বিশ্বাসের স্ত্রী হয়েই বেঁচে থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে অঞ্জলি বিশ্বাসের ভরণপোষণ দেবে কে? কীভাবে কাটবে তার বাকি জীবন।
বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে হিন্দু নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। হিন্দুদের বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো আইন নাই। অথচ হিন্দু আইনে একজন পুরুষ যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পারেন কিন্তু স্ত্রী চাইলেও বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারেন না। ভরণপোষণের ক্ষেত্রে অবশ্য এ সংক্রান্ত আইন রয়েছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্যমূলক আইন। মুসলিম আইনে নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন এবং সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার তাঁদের রয়েছে। কিন্তু হিন্দু আইনে উত্তরাধিকারী হলেও ক্ষেত্র খুবই সীমিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রচলিত দায়ভাগ মতবাদে হিন্দু নারীরা জীবনস্বত্বে এবং স্ত্রীর মালিকানাধীন এ দুভাবে উত্তরাধিকারী হতে পারেন। জীবনস্বত্বের ক্ষেত্রে এ সম্পত্তি কোনো নারী বেঁচে থাকা পর্যন্ত ভোগদখলের এখতিয়ার লাভ করেন। কিন্তু আইনগত কারণ ছাড়া এ সম্পত্তি তিনি হস্তান্তর করতে পারেন না। তাঁর মৃত্যুর পর ওই সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারীর ওপর না বর্তিয়ে যাঁর কাছ থেকে এটি পেয়েছিলেন তাঁর নিকটবর্তী উত্তরাধিকারীর কাছে চলে যায়। তবে স্ত্রীর নিজস্ব কোনো সম্পত্তি হলে তা তাঁর উত্তরাধিকারীর মধ্যে বর্তাতে পারে।
ভারতে ১৯৫৬ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত আইন পাস হওয়ার পর পিতার মৃত্যুর পর পুত্র ও কন্যা সমান অংশ লাভ করে। মুসলিম আইনে সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে পিতাই সন্তানের আইনানুগ অভিভাবক। তবে মা সন্তানের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত দেখাশোনা করতে পারেন। হিন্দু আইনে বাবার পর মা সন্তানের অভিভাবক হতে কোনো বাধা নেই।
হিন্দু বিয়েতে রেজিস্ট্রেশনের কোনো বিধান নেই ফলে বিয়ে তালাক কিংবা একই স্বামীর একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আইনি সহায়তা পান না হিন্দু নারীরা। এভাবে হিন্দু নারীরা বিয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। মুসলিম আইনে বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন আইন অনুযায়ী, এ বিধান না মানা হলে শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু নির্যাতনের শিকার হিন্দু নারীরা এ ক্ষেত্রে প্রতিকার পায় না। অনেকেই এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ের সমর্থননামা সম্পন্ন করে থাকেন। কিন্তু রেজিষ্ট্রেশন আইন না থাকায় এটিরও ভিত্তি তেমন থাকে না। অথচ ভারতে হিন্দু বিয়েতে রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আমাদের দেশে পারিবারিক ও দাম্পত্যবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা ও বিরোধের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করা হয় এবং উল্লিখিত আইনগুলো মূলত ধর্মীয় বিধান মতে রচিত হওয়ায় এ দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আইন প্রচলিত রয়েছে।
অন্যদিকে খ্রিস্টান ধর্ম মতে, বিয়ে সামাজিক বন্ধন। যার মাধ্যমে নারী-পুরুষ তাদের বংশ বিস্তার করতে পারে। পাশাপাশি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম মতে বিয়ে একটি ধর্মীয় বিষয়। এ ছাড়া মুসলিম বিয়েতে স্ত্রীরা স্বামীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মোহরানা পায় এবং বিবাহবিচ্ছেদ হলে তিন মাসের খোরপোষ (ভরণপোষণ) পায়; কিন্তু অন্য ধর্মে এ জাতীয় কোনো বিধান নেই। মুসলিম বিয়ে একটি চুক্তি হিসেবে গণ্য হওয়ায় বিয়ের কাবিননামা অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হয়, মুসলিম বিয়ে রেজিস্ট্রেশন না করলে তা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ; কিন্তু হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কোনো আইন আমাদের দেশে হয়নি। ফলে এসব ধর্মের অনুসারী স্বামী যদি বিয়ের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে তবে স্ত্রীর বিয়ে প্রমাণের কোনো উপায় থাকে না।
কয়েক বছর আগে আইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আইন কমিশন হিন্দু আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে হিন্দু বিয়ে রেজিষ্ট্রেশন, বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার-সম্পর্কিত বিধানগুলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
শুধু নারী নির্যাতন বন্ধ কিংবা নারী-পুরুষের সমানাধিকার বুলি ফোটালে হবে না, পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে অভিন্ন পারিবারিক আইন গ্রহণের এ উদ্যোগকে আরও সক্রিয় করতে হবে। তবেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে, নারীর অধিকার হবে সমুন্নত।
লেখক আইনজীবী, জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া
Leave a Reply