মুহাম্মদ ছলাহ্ উদ্দিন, টেকনাফ ॥সাত বছর বয়সের যে শিশুর বাবার কোলে দাপাদাপি করে এই পৃথিবীতে নিজের আগমন জানান দেয়ার কথা, মায়ের বুকে মাথা রেখে রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখার কথা, সমবয়সী বন্ধুদের সাথে নিত্য কোলাহলে সারাদিনমান ঘর-বাড়ী মাতিয়ে রাখার কথা; সেই বয়েসেই দীর্ঘ এক বছর ধরে অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে নিকষ আঁধারের কবরে শায়িত আছে ফুটফুটে শিশু আলো। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যায় টেকনাফের গোদার বিল গ্রামের নিজ বাড়ীর কাচারী ঘরে নিমর্মভাবে নিহত হয় স্থানীয় বর্ডার গার্ড স্কুলের স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানের ছাত্র অলি উল্লাহ আলো।
সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৫ টার দিকে; যখন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল- শিশু আলোকে খেলাচ্ছলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে ভেসে আসা কাজের ছেলে মহসিন সুমন কাছারী ঘরের বারান্দায় নিয়ে আসে। বৃষ্টির বেগ বেশী হওয়ায় সুমন আলোকে কাছারী ঘরের ভিতরে ঢুকার জন্য বললে সরল মনে আলো যে-ই কাছারী ঘরের দরজা মাড়িয়ে ভিতরে পা বাড়াল অমনি পূর্ব থেকে প্রস্তুত হয়ে থাকা ইয়াকুব মুখ চেপে ঝাপটে ধরে এবং ইয়াছিন হাত-পা কসটেপ দিয়ে বেঁধে ফেলে। একটুপর আলোর মুখও কসটেপ দিয়ে বেঁধে ফেলে। পরে ৩ জনে মিলে আলোকে দরদমায় (সিলিংয়ে) তুলে ছটের বস্তার উপর আলোকে শোয়ায়। এই পর্যায়ে সুমন মাথা, ইয়াকুব হাত-পা শক্ত করে ধরে রাখে এবং ইয়াছিন আলোর গলায় ছুরি চালাতে থাকে। এ সময় বাঁচার আকুল চেষ্টায় শিশু আলোর প্রচন্ড নড়াচড়ার এক পর্যায়ে কসটেপ খুলে গেলে প্রাণপণে আকুতি জানায়, ‘তোমার পায়ে পড়ি; আমাকে মেরো না সুমন ভাইয়া’। সে আরো হয়তো কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু সুমন নির্মম হাতে মুখ চেপে ধরলে আলো আর কোন কথা বলতে পারেনি এবং এ সময় ইয়াছিন তার কাছ শেষ করে ফেলে।
হত্যাকান্ডের পর পরই এলাকাবাসীর সহায়তায় ঘাতক কাজের ছেলে মহসিন সুমনকে পুলিশ আটক করে। মহসিন পুলিশকে জানায়, সে নওগাঁ জেলার ফুলবাড়ী থানার মহাদেবপুর গ্রামের মৃত আলতাফ মিয়ার পুত্র। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পুলিশ পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের লিং রোড থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের মৃত শামসুল হকের পুত্র ঘাতক মোঃ রায়হান (২৩), টেকনাফের নয়াপাড়াস্থ ব্রীক ফিল্ড থেকে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার শ্রীপুরের আসলাম মিয়ার পুত্র ঘাতক মোঃ ইয়াকুব (২৫), গোদার বিল এলাকার আলী হোছনের পুত্র মোঃ ইসহাক কালু (৩২) ও মহেশখালীয়া পাড়ার নজির হোসেনের পুত্র নজরুল ইসলাম (২৪) কে আটক করে। এর পর দিন ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় টেকনাফ পাইলট স্কুল মাঠে শিশু আলোর স্মরণকালের জানাযা শেষে দুপুর ১২টায় আলোর বাবা উপজেলার বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এম আবদুল্লাহ এলএলবি বাদী হয়ে কাজের ছেলে মহসিন সুমনকে প্রধান আসামী করে ৫ জনকে এজাহারভূক্ত এবং আরো ৫/৭ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে টেকনাফ থানায় মামলা দায়ের করে। পুলিশ মামলাটি আমলে নিয়ে ১৩/১৭০-২০১১ নাম্বারে নথিভূক্ত করে।
এরপর থেকে দীর্ঘ এক বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো মামলা কোন কুলকিনারা হয়নি। শিশু আলো অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে শুয়ে আছে আঁধার কবরে। তার মাগফেরাত কামনায় আজ ৭ সেপ্টেম্বর তার বাবা দিনটির স্মরণে টেকনাফের গোদার বিলস্থ নিজ বাড়ীতে বোখারী খতম, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং আলো শপিং কমপ্লেক্সে আলোচনা সভা ও বায়তুশ শরফ মাদ্রাসা মাঠে এতিমদের খাওয়ানোসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন।
######################
Leave a Reply