সাগরপথে অবৈধভাবে টেকনাফ হয়ে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার থেমে নেই। পাচারকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ ট্রলার-নৌযানে করে সমুদ্রপথে নামিয়ে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষজনকে। এসব মানুষজন জীবিকার তাগিদে কিংবা বেশি আয়ের আশায় সহায় সম্বল বিক্রি করে নৌপথে মালয়েশিয়ার যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু পথে ঘটছে বিপত্তি। কারও মৃত্যু হচ্ছে সাগরপথে, কেউ আবার বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটকও হচ্ছে।বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার-টেকনাফ এলাকাকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে পাচারকারীচক্র। প্রায় সময় ফিশিং ট্রলার যোগে শত শত লোককে মালয়েশিয়া পাঠানোর চেষ্টা করা হয়।
গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে এ পর্যন্ত পুলিশ, বিজিবি, কোস্টর্গাড পৃথক অভিযান চালিয়ে ১৫৮ জনকে আটক করেছে। আর পাচারের সাথে জড়িত থাকার দায়ে অবৈধ বর্মী নাগরিকসহ ৬৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এরপরও বন্ধ হচ্ছে না মানবপাচার। এ কাজে একাধিক চক্র সহজ সরল স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের প্রলোভন দিয়ে পাচার করে যাচ্ছে। কম খরচে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতরাণার শিকার হচ্ছে নিরীহ মানুষ। প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। অল্প টাকায় স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে তারা। গত কয়েক বছরে উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে কয়েক শতাধিক লোক সাগরে প্রাণ হারিয়েছেন। কিছু লোক মালয়েশিয়ায় পৌঁছলেও অসংখ্য লোক ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে আটক হয়ে কারাগারে জীবনযাপন করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফের সর্বত্র পাচারকারী চক্রের কয়েক শতাধিক ব্যক্তি রয়েছে। পাচারকারী চক্রের প্রধান ও মাঝিদের অধিকাংশই মায়ানমারের নাগরিক। এরা কক্সবাজার, টেকনাফ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া আবস্থান করে। মায়ানমার, কক্সবাজার ও টেকনাফে অবস্থানরত দালালচক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার লোকদের ম্যানেজ করে রাতারাতি টাকা পয়সা আয়ের প্রলোভন দিয়ে ২০-২৫ হাজার টাকায় সাগর পথে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ার পাচারের ফাঁদ পাতে। এ চক্র সাগরপথে অবৈধভাবে শত শত লোককে ইঞ্জিন চালিত ফিশিং ট্রলারে তুলে দেয়। দীর্ঘ সময়ের পথে সাগরে ট্রলার নষ্ট হয়ে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে অনেক লোক মৃত্যুবরণ করেন। আর যেসব ট্রলার নষ্ট হয়না তা সর্বোচ্চ থাইল্যান্ড বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। সে দেশে পৌঁছে কেউ পাহাড়ে উঠে, আবার কেউ প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে। সেখানে অবস্থানকারী পাচারকারী চক্র কিছু কিছুকে সুকৌশলে থাইল্যান্ড বর্ডার পার করে মালয়েশিয়া নিয়ে যেতে পারলেও বাকিরা সেখানে নানাকষ্টে দিনযাপন করেন।
গত বছর অক্টোবর মাস থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযানে সাগর পথে মালয়েশিয়াগামী ১৫৮ জনকে আটক করা হয়। থানায় ১৫টি মামলা হয়েছে। প্রথম দিকে দুটি মামলায় বৈদেশিক নাগরিক আইন ও সহযোগী হিসেবে ৬ জনকে আটক করা হলেও পরবর্তীতে এ আইনের পাশাপাশি বহির্গমন অধ্যাদেশ আইনে ১৩টি মামলায় ১৫২ জন আটক করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন সংস্থা ৬৫ জন পাচারকারীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছে। মামলায় অভিযুক্ত উল্লেখযোগ্যরা হলেন, সাবরাং ইউপির শাহপরীর দ্বীপ মাঝর পাড়ার বিলকিছ বেগম, মো. সব্বির আহাম্মদ, মো. সাহাব মিয়া, আব্দুর রহমান, মোছাব্বর আহাম্মদ, আবুল বশর, নজির আহাম্মদ, সুলতান আহাম্মদ, মো. ইউনুচ, শরীফ, মমতাজ মিয়া, দক্ষিণপাড়া এলাকার ভুলু, আব্দুল মালেক, সাহাব মিয়া, রহমত উল্লাহ, কালা মিয়া, কোণার পাড়া এলাকার মাইক ইউনুচ, মো. সৈয়দ নুর, বাজার পাড়া এলাকার মো. ইসমাইল, ধলু হোসন, জিয়াবুল হক ভুলাইয়া, আবুল কাশেম, মো. শফিক, ডাঙ্গর পাড়া এলাকার মো. ফিরোজ, মো. সুফি আহাম্মদ, মো. সৈয়দ, মিস্ত্রি পাড়া এলাকার নুরুল আলম, কালা জাফর, শরীফ ভুলু, জাফর আলম, সমসের আলম, শুক্কুর, এনায়েত, শাহপরীর দ্বীপের ইসমাইল মেম্বার, পশ্চিম পাড়ার মো. মকবুল হোসেন, ঘোলা পাড়ার কবির, সাবরাং কচুবনিয়ার বশির আহাম্মদ, মো. নজির আহাম্মদ, হোয়াইক্যং খরাইংগা ঘোনার মো. আলী আকবর, পানছড়ি পাড়ার আব্দুল গফুর, শামলাপুরে অবস্থানকরী বর্মী মহিলা দালাল নূর বাহার, টেকনাফে অবস্থানকারী বমী দালাল রুহুল আমিন, নবী হোসন মাঝি ও মরিয়ম, হ্নীলা নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের মহিলা দালাল ডি ব্লকের সেতারা বেগম প্রমুখ।
স্থানীয়রা জানান, সাগরপথে মালয়েশিয়াযাত্রী অধিকাংশ উঠতি বয়সের যুবক। এদের থেকে ২০-৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় কয়েকটি ইঞ্জিন বোটে তাদের তুলে দেয়া হয়। মালয়েশিয়া লোক পাচারকারীরা স্থানীয় কোন না কোন প্রভাবশালীর ইন্ধনে এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এ চক্র।
এ ব্যাপারে টেকনাফ থানার ওসি মাহবুবুল হক বলেন, বিভিন্ন সময়ে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী লোক ও ট্রলার আটক করা হয়েছে। পাচার প্রতিরোধে আইনশৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন।
Leave a Reply