ইব্রাহিম খলিল মামুন=
মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ কেজি মাছ আমদানি হচ্ছে। এসব মাছ ইয়াঙ্গুন থেকে ঢাকায় পৌঁছে ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। এতে সময় লাগে সাত-আট দিন। এ সময় মাছগুলো হাতবদল হয় বেশ কয়েকবার। পরিবহন প্রক্রিয়ায় তাপমাত্রাও থাকে একেক সময় একেক রকম। ফলে আমদানি করা এসব মাছ হয়ে পড়ে অস্বাস্থ্যকর। জনস্বাস্থ্যের জন্য তা কতটা নিরাপদ, এ শঙ্কা যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি জোরালো হয়ে উঠেছে ফরমালিন মেশানোর সন্দেহও। বিষয়টি জনস্বাস্থ্যে ঝুকিপূর্ণ হলেও নেই কোনো তদারকি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাছ সাত দিন সংরক্ষণ করতে হলে তা প্রতিনিয়ত মাইনাস ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় রাখতে হবে। অন্যথায় এতে রোগ সৃষ্টিকারী ও ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়ার পাশাপাশি মাছের পুষ্টিগুণও কমে যায়। এক্ষেত্রে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা মাছ যে প্রক্রিয়ায় পরিবহন হয়ে ভোক্তার হাতে পৌঁছ, তা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত থাকছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে মত্স্য গবেষণা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ গোলাম হোসেন বলেন, মাছ এয়ারটাইট অবস্থায় মাইনাস ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট তামপাত্রায় বেশকিছু দিন ভালো থাকতে পারে। তবে তাপমাত্রা ওঠানামা করলে এবং অবস্থান বদল হলে মাছের কোষ ও টিস্যু নষ্ট হয়ে যায়। এতে মাছে যে প্রোটিন থাকে, তার গুণাগুণও নষ্ট হয়।
মিয়ানমার থেকে সাধারণত রুই-কাতলার মতো কার্পজাতীয় চাষের মাছই বেশি আসে। সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি হচ্ছে পাঙ্গাশও। এসব মাছ বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে ইয়াঙ্গুনের বাজার থেকে আমদানি করা হয়। ধরার পর সাত-আট দিন পর এসব মাছ ট্রলার, ট্রাক, ভ্যান ও কাভার্ড ভ্যানে ৯৫০ থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্ব পেরিয়ে পৌঁছে বাংলাদেশের ভোক্তার কাছে।
বণিক বার্তার নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাছ ধরার পর তা টেকনাফ পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগে পাঁচ-ছয় দিন। এ সময় প্রতিটি মাছ আলাদা পলিব্যাগে ভরে কাঠের ট্রলারের পাটাতনে বরফ দিয়ে রাখা হয়। মাছগুলো সাধারণত শূন্য থেকে মাইনাস ১ ডিগ্রি ফারেনহাইট তামপাত্রায় টেকনাফে আসে। তবে অনেক সময় প্রয়োজনীয় বরফের অভাবে স্বাভাবিক তাপমাত্রায়ও মাছ টেকনাফ বন্দরে এসে পৌঁছে।
টেকনাফে খোলা আকাশের নিচে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এসব মাছ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। মত্স্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা মাছে ফরমালিন রয়েছে কিনা, শুধু তা-ই পরীক্ষা করেন। মাছে পচন ধরেছে কিনা বা তার পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করা হয় না। টেকনাফে হাতবদলে সময় লাগে ৩-৪ ঘণ্টা। এ সময় মাছ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকে। তারপর সেগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাভার্ড ভ্যানে চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাটে নেয়া হয়। কাভার্ড ভ্যানের তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রি থাকে বলে দাবি করেন পরিবহনমালিকরা। ফিশারি ঘাটে হাতবদল হয় আরেকবার। এরপর সাধারণ ট্রাক বা পিকআপে বরফ দিয়ে এসব মাছ প্রথমে ঢাকায় আসে। তারপর ঢাকায় আরেকবার হাতবদল হয়ে যায় ময়মনসিংহ, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুরসহ সারা দেশে।
এ রকম পরিবহন প্রক্রিয়ায় মাছ কীভাবে তরতাজা থাকে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন মত্স্যবিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, সাধারণ বরফে মাছ সর্বোচ্চ ছয় দিন ভালো রাখা যেতে পারে। তবে তাপমাত্রার ওঠানামা হলে বা হাতবদল হলে তা নষ্ট হতে বাধ্য। এক্ষেত্রে মাছের রঙ বদল হবে এবং তাতে পচন ধরবে। কিন্তু মিয়ানমারের মাছে তা হচ্ছে না। তাহলে কি এ মাছে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে— এ প্রশ্ন বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তার।
তবে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, মিয়ানমার থেকে মাছ ফরমালিন ছাড়াই চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে। যদি ফরমালিন মেশানো হয়, তা টেকনাফের বাইরে অন্য কোনো স্থানে।
টেকনাফ স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহেতেশামুল হক বাহাদুর জানান, ইয়াঙ্গুন থেকে আমদানি করা এসব মাছ কাভার্ড ভ্যানে করে চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট ও ঢাকায় যাত্রাবাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে বাজারে সরবরাহ হয়। কাভার্ড ভ্যানে যে ফ্রিজিং ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে মাছ কয়েক দিন নিরাপদে রাখা সম্ভব। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রামে ফরমালিন মেশানো হয় কিনা, তা তিনি জানেন না।
এদিকে চট্টগ্রাম ফিশারি ঘাট মত্স্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুর হোসেন দাবি করেন, ফিশারি ঘাটে ফরমালিনের কোনো ব্যবহার নেই। তিনি জানান, চট্টগ্রাম থেকে কিছু মাছ সাধারণ ট্রাকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী আড়তে যায়। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে তা সরবরাহ হয়। পথে কেউ ফরমালিন মেশালে তা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মিয়ানমার থেকে প্রতিটি মাছ যে পলিব্যাগে আনা হয়, কেবল ফরমালিন মেশানোর জন্যই টেকনাফে তা ফেলে দেয়া হয়। পলি ব্যাগে থাকলে ফরমালিন মিশ্রিত পানি বা বরফ মাছের গায়ে লাগবে না বলেই এটি করা হয়।
এ বিষয়ে মত্স্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, আমদানিকৃত মাছে যাতে ফরমালিন মেশানো না হয়, ফরমালিন ব্যবহার বন্ধে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন বণিক সমিতি ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এ ব্যাপারে নিয়মিত নজরদারি করছে।