আবদুল্লাহ নয়ন,
আদরের সন্তানের জন্য মা-বাবা, ভালবাসার স্বামীর জন্য স্ত্রী, প্রিয় বাবার জন্য সন্তান আর ভাইয়ের জন্য ভাই চোখের জলে তারা বুক ভাসাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বেঁচে আছেন ভেবে আশায় বুক বাঁধেন আবার বন্দিদশা আর মারা যাওয়া কথা ভেবে ডুকরে কেঁদে উঠেন তারা। একটি দুটি নয়; টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কুতুবদিয়া পাড়া, উংছিপ্রাংসহ বিভিন্ন স্থানে ১৪টি পরিবারে চলছে কান্নার রোল। সম্প্রতি সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রাক্কালে ২৬ জনের মৃত্যু আর ৮২ জনের বন্দির খবরে তাদের স্বজনরা এখন দিশেহারা।
বুধবার সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের গত ১০ মে ১০৮ জন আদম নিয়ে যে ট্রলারটি সমুদ্র পথ দিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি জমায়, সেই ট্রলারে যাত্রীদের মধ্যে ছিল টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কুতুবদিয়া পাড়ার আবদুশ শুক্কুরের পুত্র মোহাম্মদ হারুন (২৭), আবদুর রহিমের পুত্র আবছার উদ্দিন (২০), শামসুল আলমের পুত্র সরওয়ার (১৯), নুরুল আলমের পুত্র আবদুর রহিম (২০), আবদুস সবুরের আজিজুল হক (৩০), নুর আহমদের পুত্র মীর কাসেম (২০), আবু তালেবের পুত্র মোহাম্মদ রফিক (২৪), কবির আহমদের পুত্র মোহাম্মদ আনিছ (৩০), একই ইউনিয়নের উংছিপ্রাংয়ের আবদুর রহমানের পুত্র শাহ আলম (২৫), রইক্যং এর কালা মিয়ার পুত্র আবু ছিদ্দিক (৩০), আমির হামজার পুত্র আবদুল করিম (৩০), উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের মোহাম্মদ বশিরের পুত্র ফুতু ও শফিকুর রহমানের পুত্র এবাদুল্লাহ। এছাড়া চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার শেকের বিল ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের বাদশাহ মিয়ার পুত্র আবদু জব্বার ও আবুল বশরের পুত্র আনোয়ারুল ইসলাম।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে উক্ত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সব কটা পরিবারই নিন্ম আয়ের। যারা দিনে আনে দিনে খায়। মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে যারা ঘর ছেড়েছেন-তাদের মধ্যে অনেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম।
শামসুল আলম নামে এক পিতা জানান, টেকনাফের জনৈক এক দালাল স্বল্প খরচে মোটা অংকের বেতনের চাকরীর আশা দিয়ে তাদের ছেলেদেরকে মালয়েশিয়া যেতে উদ্ধুদ্ধ করে। অনেকের পিতা-মাতা রাজি না হওয়ায় দালাল কৌশলে ছেলেদের লোভে ফেলে মালয়েশিয়া যেতে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে। এক পর্যায়ে অনেকে পরিবারের কাউকে না বলে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর থেকে আর তাদের সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি কিংবা দালালেরাও তাদের কোন খোঁজ দেয়নি। গতকাল সাংবাদিকরা ওইসব পরিবারের কাছে গেলে তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
মালয়েশিয়াগামী যুবকদের অভিভাবকরা জানান, একজনকে মালয়েশিয়া নিতে দেড় লাখ থেকে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত তারা দালালের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রথমে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করবে। পরে তারা মালয়েশিয়া পৌঁছালে ওই দালালদেরকে বাকি টাকা পরিশোধ করবে তাদের অভিভাবকরা। কিন্তু সমুদ্র পথে নয় তাদেরকে বিমানে করে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে টাকা নেয় দালালরা।
আবদুর রহিম নামে এক অভিভাবক জানান, তারা টাকা দিয়েছেন টেকনাফের এক দালালকে। ওই জনৈক ওই দালাল টাকা ও যুবকদের সাবরাংয়ের ভুট্টো, শাহেদ ও ফারুক দালালের হাতে তুলে দেন। ঘর থেকে বের হওয়ার পর তারা আর সন্তানের কোন খবর পাননি।
এদিকে সন্তান, ভাই, স্বামী ও পিতার জন্য অপেক্ষায় থাকা স্বজনের প্রতিনিয়ত কান্নায় বুক ভাসাচ্ছেন। অনেক মা ও স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ওই সব পরিবারগুলো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন গুনছেন।
এব্যাপারে হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, আদম পাচারকারী পুরো টেকনাফ জুড়ে ছেয়ে গেছে। অনেক আদম বেপারী সেই টাকা নিয়ে ওমরাহ করতেও গেছেন। আমরা জনগণকে সচেতন ও বারণ করছি-যেন মৃত্যু ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া না যায়।
Leave a Reply