মমতাজুল ইসলাম মনু টেকনাফ। আশির দশকের শুরুতে বিশেষ একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের কিছু রোহিঙ্গা নাগরিক। মানবিক দিক বিবেচনা করে সেদিন আশ্রয় দিয়েছিল স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। দায়িত্ব ও মমত্ব বোধ থেকে মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা মুসলিম-জনগোষ্টিকে আশ্রয় দিয়ে যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে তা পৃথিবীর মানুষ কোনদিন ভুলতে পারবেনা। তাইতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সউদী আরব বাংলাদেশকে বলে‘বাঙ্গালী কোয়াইছ’অর্থাৎ বাঙ্গালী ভাল। আশ্রিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য একদিন বিষফোঁড়া হবে তা কিন্তু কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি কোনদিন। অথচ তা-ই হলো। রোহিঙ্গারা আজ বাংলাদেশী মানুষের মাথার উপরে বসে উকুন মারতে চাইছে! আশির দশকের গোড়ার দিকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কিছু রাজ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতন,মসজিদ,ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ,হত্যা,গুম,ছিনতাইসহ ব্যাপক নির্যাতন চালায় মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। এহেন নির্যাতনে অতীষ্ট হয়ে সেবছর হাজার হাজার রোহিঙ্গা এ দেশে পাড়ি জমায়। আশ্রিতের জন্য স্থাপন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। সাথে খাদ্য ও মানবিক সহায়তারও ব্যবস্থা করে সরকার। বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় ইউএনএইচসিআর,রেডক্রিসেন্ট,এমএসএফ,অক্সফামসহ পৃথিবীর নামকরা সব এনজিও এখানে শুরু করে মানবসেবা। মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য,স্বাস্থ্য,বাসস্থান ও শিক্ষা মেটাতে অকুন্ঠিতচিত্তে সেবা অব্যাহত রাখে সরকার অনুমোদিত এসব বেসরকারী সংস্থাগুলো। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা পেল থাকার জায়গা,পরনের কাপড়,মুখের ভাত,চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের যাবতীয় যোগান। অসমর্থিত একটি সূত্র মতে,মিয়ানমারে সরাসরি নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের ঘরে বসে সরকারী-বেসরকারী সুযোগ সুবিধার কথা নাফনদীর ওপারের অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়লে নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি এমন হাজার হাজার রোহিঙ্গাও বাংলাদেশে পাড়ি দেয়া শুরু করে। সেই যে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু যা আজো শেষ হয়নি। রোহিঙ্গারা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন দল বেঁধে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিচ্ছে আন-রেস্টিার্ড বস্তিতে (স্থানীয় ভাষা টাল)। পৃথিবীর কোন দেশে অন্য দেশের নাগরিক অবৈধভাবে অবাধে চলাফেরা ও বসবাস করতে পারেনা। তাদের আটক করে হাজতে রাখা হয়। পরে সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে কথা বলে ফেরত পাঠানো হয়ে থাকে। অবশ্য বাংলাদেশ বিশেষ প্রেক্ষাপটে আশ্রয় নেয়া কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত) স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে সেদেশের সাথে কথা বলে। নয়াপাড়া-১,নয়াপাড়া-২ ও লেদা [আন-রেজিস্টার্ড] রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশী মিয়ানমারের নাগরিক বাস করছে। টেকনাফের অন্যান্য স্থানে অবৈধভাবে বসবাস করছে আরো অন্তত ১০ হাজার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক। সম্প্রতি আরাকান রাজ্যে ঘটে যাওয়া মুসলিম-বৌদ্ধ ডাঙ্গার কারণে সৃষ্ট আর্থিক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংকট হওয়ায় পারিবারিক চাহিদা মেটাতে পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছে অগণিত রোহিঙ্গা। পক্ষান্তরে মুদ্রার ব্যবধান বিশাল হওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা টেকনাফ তথা বাংলাদেশকে মধ্যপ্রাচ্য বিবেচনা করে কাজের সন্ধানে আসছে এখানে।,ভাড়া ঘর নিজস্ব উদ্যোগে তৈরী করা ঝুপড়ি কিংবা লোকালয়ের আত্মীয়ের ঘরে। এখান থেকে তারা বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও মুদির দোকানে কর্মচারী হিসাবে কাজে ঢুকে পড়ছে। রোহিঙ্গা শ্রমিকের কারণে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। মানবেতর দিনযাপন করছে অসংখ্য স্থানীয় গরিব-দুঃখী পরিবারের বেকার যুবকরা। এছাড়াও গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন কৃষিনির্ভর এলাকা গুলোতে কৃষিশ্রমিক হিসাবে রোহিঙ্গারা অবাধে কাজ করছে। এ দেশীয় শ্রমিকের মজুরের তুলনায় রোহিঙ্গা শ্রমিকের মজুরি কম হওয়ার সুবাদে স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের কাজ দিচ্ছে। স্থানীয় শ্রমিক মালিক আবুল কাশেম (৫৫) জানান, রোহিঙ্গারা সীমান্ত পার হয়ে এখানে আসা মাত্র কাজ পেয়ে যায়, তারা কম টাকায় কাজ করে। টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো অরক্ষিত হওয়ার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। বিশেষ করে লেদা (আন-রেজিস্টার্ড ) রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণই নেই। এখানে কোন পুলিশ বিজিবি নেই। এ ক্যাম্প এখন রোহিঙ্গা অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। অপরাধের মাত্রা এতই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে,অবৈধ মিনি ভিসিআর হলে অশ্লীল ছায়াছবি,দিন দুপুরে জুয়া মাদক পাচারের নিরাপদ জায়গা। অনেকে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যেও জড়িয়ে পড়ছে। শ্রমের বাজার এখন রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে বললেই চলে। তারা এখানকার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ায় এলাকার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিরও অবনতি হচ্ছে । চুরি-ডাকাতি সন্ত্রাসের মত জঘন্যতম কাজ পরিচালিত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বে। রোহিঙ্গারা টেকনাফ তথা বাংলাদেশকে দ্বিতীয় জন্মভুমি মনে করে এখানে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। টেকনাফের বাহারছড়া উপকূলের সমুদ্র সংলগ্ন ঝাউবীথির আড়ালে গড়ে উঠেছে বিশাল রোহিঙ্গা বস্তি। এ ছাড়াও শাহপরীর দ্বীপ,দমদমিয়া,সাবরাং,হ্নীলা,টেকনাফের কাইয়ুক খালী পাড়ায় ছোট ছোট রোহিঙ্গা বস্তি দেখা যায়। এসব রোহিঙ্গারা সামুদ্রিক মাছ ধরার নৌকায় মাঝি-মাল্লা কখনো রিক্সা চালক হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। এ রোহিঙ্গাদের ইন্ধন ও প্ররোচনায় সীমান্তে বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করে ওই বস্তিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরে তারা বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় ট্রলার মালিক নুর মোহাম্মদ (৪৫) জানান, মনখালী-বাহার ছড়া উপকূলে পাঁচ শতাধিক জেলে নৌকায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা শ্রমিক কাজ করছে। এদের কারণে স্থানীয় জেলেরা কাজ না পেয়ে আর্থিকভাবে চরম বেকাদায় আছে। রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফে ১২০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকার শ্রমের বাজার দখল করে নিয়েছে। লেদা আন-রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী এক রোহিঙ্গা জানায়,বাংলাদেশী ১ টাকার বিপরীতে মায়ানমারের ১০ কিয়ট সে দেশে লেনদেন হওয়ায় পাশাপাশি মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে চলাফেরা উপর কড়া নজরদারী থাকাতে অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়ায় রোহিঙ্গারা পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় অথবা এখানে এসে স্বনির্ভর হতে আগ্রহী হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে লোকালয়ে মিশে যাচ্ছে। তারা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চলে। রোহিঙ্গারা পারিবারিক চাহিদা মেটাতে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রতিনিয়ত বিচ্ছিন্নভাবে অনুপ্রবেশ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তের নাফ নদীর কিছু চিহ্নিত পয়েন্ট দিয়ে বিজিবির কড়া নজরদারীকে ফাঁকি দিয়ে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। ঈদের পর থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে পত্রিকান্তরে জানা যায়। বর্তমানে টেকনাফে লাখেরও বেশী ভাসমান রোহিঙ্গা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছে। এসব রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির আশংকা করছেন সচেতনমহল। টেকনাফ উপজেলা বিদায়ী নির্বাহী কর্মকর্তা আ.ন.ম.নাজিম উদ্দিন লেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা দরকার। উখিয়া-টেকনাফের দুটি ক্যাম্পে বিদ্যমান রোহিঙ্গা ছাড়াও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় দুই লাখ ভাসমান রোহিঙ্গার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে বিজিবির আওতায় সীমান্তের হ্নীলা ও শাহ্পরীর দ্বীপে যে দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। তার পাশাপাশি হাটে-বাজারে কর্মস্থলে রোহিঙ্গাদের বিচরনের জায়গা চিহ্নিত করে ডিটেনশন কেন্দ্রের আওতায় এনে ব্যবস্থা গ্রহনের উপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি। ===
Leave a Reply