টেকনাফ/ জামায়াতের সঙ্গে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ‘তলে তলে যোগাযোগ’ থাকতে পারে বলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তা বিরোধী রাজনৈতিক জোটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তবে জামায়াতে ইসলামী খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যকে ‘ইতিবাচক’ বলে মনে করছে। দলটির তিনজন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে এ কথা জানা গেছে। তাঁদের যুক্তি, এই বক্তব্যের মাধ্যমে খালেদা জিয়া দুটি বিষয় তুলে ধরেছেন। একটি হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নামে সরকার যে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, সেটি দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করেছেন। অন্যটি হচ্ছে, এই নির্যাতনের চূড়ান্ত লক্ষ্য যে জামায়াতকে জোটের বাইরে আনা, তা-ও প্রকাশ করা হয়েছে। তবে খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। এ কারণে এই তিন নেতা পত্রিকায় নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
খালেদা জিয়া গত রোববার কক্সবাজারের রামুতে সম্প্রীতি সমাবেশে বলেন, ‘…আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা যায় না। ১৮ দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তলে তলে তারা যে যোগাযোগ করছে না, তা কে জানে!’ তিনি আরও বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে কীভাবে জামায়াতকে পক্ষে নেওয়া যায়, তার চেষ্টা আওয়ামী লীগ করে যাচ্ছে।
এই বক্তব্যের ভিত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওনার (খালেদা জিয়া) কাছে নিশ্চয়ই এ বিষয়ে তথ্য আছে। এর সত্যতা আছে বলেই তিনি এ কথা বলেছেন।’
খালেদা জিয়া ভারত সফর শেষে ৩ নভেম্বর দেশে ফেরেন। এর এক দিন পর জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন। এর রেশ না কাটতেই বিএনপির চেয়ারপারসন এই বক্তব্য দিলেন। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই তিনটি ঘটনা থেকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের টানাপোড়েনের যোগসূত্র খুঁজছেন। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানামুখী আলোচনা চলছে। বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের একাধিক নেতা অতীতে জামায়াতের কয়েকটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের খতিয়ান সামনে আনছেন। এ ক্ষেত্রে ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সামরিক শাসক এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া এবং ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সমঝোতার’ নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরা হচ্ছে।
বিভিন্ন মহল থেকে বলাবলি হচ্ছিল, খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফর এবং দেশটির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা ভালোভাবে নেয়নি জামায়াত। কারণ, এর আগে জামায়াতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তাদের নেতাদের যে বিচার চলছে, তা প্রতিবেশী দেশের এজেন্ডা।
অবশ্য, জামায়াতের নেতারা এ ধরনের চিন্তাকে নাকচ করে দিয়ে গণমাধ্যমে খালেদা জিয়ার ভারত সফরের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে তাঁরাও আগ্রহী। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতের দ্বারা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থহানি হচ্ছে। কথাগুলো সোচ্চার কণ্ঠে বলেন বলেই তাঁদের ভারতবিরোধী বলা হয়।
সম্প্রতি কক্সবাজারের সমাবেশে খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, এ বিষয়ে বিএনপির মুখপাত্র ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, নিশ্চয়ই খালেদা জিয়া এমনি এমনি এ কথা বলেননি।
বিএনপির কাছে এ বিষয়ে কী তথ্য আছে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সবকিছুর তথ্য খুঁজলে তো সমস্যা। এটা তো পরিষ্কার যে সরকার একদলীয় নির্বাচন করতে চায়। সে জন্য সবাইকে নিয়ে গুঁতোগুঁতি করছে।’
এম কে আনোয়ার মনে করেন, আওয়ামী লীগ যেকোনো উপায়ে জামায়াতকে বিএনপির কাছ থেকে নিয়ে তাদের সঙ্গে মেলাতে চায়। অতীতে বহুবার এ রকম হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচন এবং ২০০৬ সালে শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের খেলাফত মজলিসকে চারদলীয় জোট থেকে বের করে নিয়ে আওয়ামী লীগের পাঁচ দফা চুক্তির কথা উল্লেখ করেন।
খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের পর বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক থাকছে কি না, বা জামায়াত নতুন করে বিএনপির সন্দেহে পড়ল কি না—১৮ দলীয় জোটে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অবশ্য এই আশঙ্কার কথা নাকচ করে দিয়েছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা মূলত জামায়াতের ওপর সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদস্বরূপ। আজকের (গতকাল সোমবার) ১৮ দলীয় জোটের গণমিছিলে বিএনপির নেতাদের বক্তৃতায়ও এটি প্রতিফলিত হয়েছে।
Leave a Reply