আলী প্রয়াস =মহান দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হবে শহর থেকে দূরে নির্জন কোন জায়গায়, যেখানে থাকবে না কোলাহল, পরিবেশ হবে মুক্ত, শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠবে অপরূপ প্রাকৃতিক কোলে আর প্রকৃতি হবে তাদের শিক্ষক।’ সেই আদলে যেন যাত্রা শুরু করেছিল দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ঘড়ির কাঁটার মতো অবিরাম ছুটে চলা প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি, পাওয়া আর না পাওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ চবি ২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর পূর্ণ করলো মর্যাদার ৫০ বছর। তাই সে উপলক্ষে উৎসবে রূপ নিয়েছে পুরো ক্যাম্পাস। বর্ণিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত প্রতিটি আঙিনা। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠালাভের পর থেকে জ্ঞানের আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞানের পাশাপাশি ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন, ৭১’র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেখেছে গৌরবোজ্জ¦ল ভূমিকা।
দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় সমস্যা-সম্ভাবনা আর প্রত্যাশা-প্রাপ্তির দুরূহ সমীকরণের বাইরে এক প্রদীপ্ত আলোক মশাল, দেদীপ্যমান সূর্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আভ্যন্তরীণ অনেক নেতিবাচক দৃষ্টান্ত থাকা সত্তে¦ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি কুড়িয়েছে। সর্বাধুনিক ও মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। তাই এই অর্জনের সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে চবি প্রশাসন বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালন করছে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস তথা প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তী।
১৯৬৬ সালের ২৮ নভেম্বর কলা অনুষদের বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস এবং অর্থনীতি বিভাগের ২০০ ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে শুরু হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। বর্তমানে প্রায় ২২ হাজার ছাত্র-ছাত্রী এখানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে। গত অর্ধশতাব্দী জুড়ে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শেষে জীবন ও জীবিকার তাগিদে দেশে ও বহির্বিশ্বে পাড়ি জমিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানের খবর শুনে অনেকে আবেগে আলোড়িত হয়েছে। অনেকেই স্মৃতির রাজ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছে ফেলে আসা সেই সব দিনের কথা। মনের অজান্তেই ভেসে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের আড্ডার কথা। অনেক সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো নাড়া দিচ্ছে…সেই শাটলে গাদাগাদি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কোরাস গানের সুর, কিংবা ফিরতি শাটল ট্রেনে সেই দু’জনার একান্তে বসে মনের ভাব বিনিময়ের মধুর দিনগুলো আবার অনেককে আন্দোলিত করছে। ক্যাম্পাসের লাল ইটের ভবনগুলোর কোনো এক জায়গায় সহপাঠীদের নিয়ে জম্পেশ আড্ডা, মউর দোয়ানের অফুরন্ত চা-সিঙ্গারা, ক্লাসের ফাঁকে বারান্দায় স্যারদের চোখ এড়িয়ে সিগারেট সাবাড়, এরকম হাজারো টুকরো স্মৃতি মনকে নাড়া দিচ্ছে। শিক্ষা জীবনের এসব মধুরক্ষণ স্মরণ করে নতুনভাবে রোমাঞ্চিত হচ্ছে প্রাক্তনরা। ভাবনার অতলান্তে ডুব দিয়ে তারা দেখছে সবই আজ ফেলে আসা অতীতের খেরোখাতা!
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গত ৫০ বছরে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মর্যাদাপূর্ণ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা জীবনের এই গুরত্বপূর্ণ সময়ের সারথীরা তাদের অতি পরিচিত ক্যাস্পাসটির তথা প্রতিষ্ঠানটির এমন গৌরবময় উৎসবে সামিল হতে কে না চাইবে? এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনযজ্ঞে শরিক হতে পেরে সবাই আনন্দে উজ্জীবিত। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকের পক্ষেই হয়তো শতবছর পূর্তি উৎসবে যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হবে না। তাদের জন্য এবারের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের উৎসবটি তাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিটি মুহূর্ত তারা আরও আনন্দ ও উৎসবের আমেজে স্মরণীয় করে রাখতে চাইছে। এ প্রাণের মিলন মেলায় নিজেকে হারাতে চাইছে পুরনো শিক্ষার্থীরা। বন্ধুদের মাঝে নিজেকে মেলে ধরতে চাইছে হারানো সময়ের দর্পণে। কেউ কেউ বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও প্রাক্তন ছাত্ররা দীর্ঘদিন পর সতীর্থ, বন্ধুদের কাছে পাবে। তখন যেন তারুণ্যের সেই দিনগুলোতে হারিয়ে যাবেন তারা। বয়সের কথা ভুলে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারিদিকে ছোটাছুটি করবেন সহপাঠী, বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে, কোলাকুলি, স্মৃতি হাতড়িয়ে সেই যৌবনের জীবনে ফিরে যাওয়ার আকুলতাসহ সব মিলে এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দিবে দিনটিতে।
প্রকৃতির অপরূপ শোভায় শোভিত দেশের অন্যতম শিক্ষাতীর্থের নাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর অপূর্ব এই বিশ্ববিদ্যালয়টির মনোরম সৌন্দর্য সকলকে আকষর্ণ করে। পাহাড় আর সবুজের সজীবতায় ঘেরা যেন এক তিলোত্তমা অঙ্গন। কি নেই এই বিদ্যাপীঠে? পাখির কলতান আর শাটলের হর্ণ দিয়ে শুরু হয় দিন এই জ্ঞানরাজ্যে, পড়ন্ত বিকালে কাটা পাহাড়, ঝুপড়ির আড্ডা, গিটারের সুর। শাটলগায়করা মাতিয়ে রাখছে তো রাখছেই সারাক্ষণ। আর চোখ মেললে দেখি, দেশ-বিদেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের অনেকেই ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র। বর্তমান সময়েও দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। শুধু অবদানই নয়, গর্ব করার মতো কিছু মানব মনীষার পদধুলিতে সিক্ত হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ করে উপমহাদেশের খ্যাতিমান ভৌত বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম, নোবেল বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আন্তর্জাতিক সমাজবিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ সাহিত্যিক ড. অনুপম সেন, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক আবুল ফজল, কথাসাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ, কবি অনুবাদক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান, শিল্পী মুর্তজা বশীর, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিজিবির মহা পরিচালক আবুল হোসেন, কবি ময়ুখ চৌধুরী কবি মহীবুল আজিজ, শিল্পী ঢালী আল মামুন, ঢাকার মেয়র আনিসুল হকসহ দেশ বরেণ্য বহু কীর্তিমানদের অবদানে গৌরবান্বিত আজকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এখনও দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কৃতি ছাত্র। এইসব কৃতি সন্তান এক সময় দাপিয়ে বেড়াতেন এই সবুজ ক্যাম্পাসে।
সেই গৌরবময় ক্যাম্পাস আজ বাহারি সাজে সেজেছে। ক্যাম্পাসসহ পুরো শহর জুড়ে উৎসবের আমেজ। চবি সাদরে বরণ করতে প্রস্তুত তার সকল সূর্য সন্তানদের। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমগুলো সরগরম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন ‘স্বপ্নের ভূবনে সবাইকে একত্রিত করতে এই আয়োজন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখাতে চাই। যাতে অপার সম্ভাবনাময় তরুণ শিক্ষার্থীরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারে। অতীতের মতো আগামী দিনগুলোতেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও আধুনিক মানবসম্পদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ, অহংকার ও গৌরব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিন্দ্য সুন্দর সবুজ ক্যাম্পাসে স্বাগত জানিয়ে উপ-উপাচার্য শিরীণ আখতার বলেন ‘এ বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সকলের প্রাণ। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের দীপশিখা জ্বালিয়ে সমাজ, দেশ ও জাতিকে আলোকিত করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবগাথা দেশ ও জাতির কাছে সমুজ্জ্বল। অত্যন্ত আনন্দের সাথে বলতে হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা আজ দেশ ও জাতির বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একইসাথে দেশে-বিদেশে উচ্চ পদে মর্যাদাসীন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন এবং দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা ও দৃশ্যমান অবদান রেখে চলেছেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম মূল লক্ষ্য একটি জাতির মধ্যে আত্মবিশ্বাসের স্ফুলিঙ্গ সঞ্চার করা। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা ও বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় একটি সমাজের জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা-সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার শক্তির জাগরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। হুমায়ূন আজাদের ভাষায় ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র, দেশের ভেতরে সবচেয়ে মুক্ত, স্বাধীন ও স্বায়ত্ত্বশাসিত পরিম-লের নাম বিশ্ববিদ্যালয়।’ মূলত একটি রাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ কেমন তার উপর নির্ভর করে রাষ্ট্রটি কত শক্তিশালী কিংবা দুর্বল হবে। চবিসহ দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন এই আদর্শ ধরে রাখতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় যেন জাতি নির্মাণের সত্যিকার কারখানায় রূপান্তরিত হয় সেই আশা আজ ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব পালনকারী আমার, আপনার, সবার।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পার করা কম গৌরবের কথা নয়! চবি আজ সেই সফল গৌরবের অংশীদার। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও আলোক সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের মহান ব্রত নিয়ে অর্ধশত বছরে পা রাখা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে উদারনৈতিক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম উপহার দিতে সদাসচেষ্ট থাকুক। কেবল গুণগত শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমেই মানবসম্পদ তৈরী ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। আমাদের প্রত্যাশা জ্ঞান ও মেধানির্ভর শিক্ষাকার্যক্রমের মধ্য দিয়ে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সর্বৈব সুন্দরের পথে উত্তরিত হবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। গৌরবময় সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবের এই আনন্দ মুহূর্তে নিরন্তর এই শুভকামনাই রেখে যাই। সেই সাথে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন হোক সদা শান্তিময় ও শিক্ষাময়। বিশ্ববিদ্যালয় হোক জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মূল কেন্দ্রবিন্দু। ৫০ বছরের অর্জিত গৌরব ও সম্মান নিয়ে আরও হাজার বছর প্রাণবন্ত থাকুক এই ক্যাম্পাস। আজকের আনন্দ উচ্ছ্বাস চলতে থাকুক যুগ যুগ ধরে। নতুন পুরাতনের মেলবন্ধন শুভ-সুন্দরের বার্তা নিয়ে আসুক। ক্যাম্পাস হোক আনন্দময়। জয়তু চবির সুবর্ণ জয়ন্তী।
১৭.১১.২০১৬
আলী প্রয়াস
০১৮১৯৪২২৬১৮
Leave a Reply