ফারুক আজিজ:: টঙ- এ চা খাওয়ার জন্যে বসেছি আমি এবং আমার হাসিমাখা বন্ধু আতিক। শহরে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানকে টঙ-ই বলে। টঙ- এর চায়ের স্বাদ আলাদা। মজা, মজালো এবংমন- মজানো। চা খেতে খেতে বিভিন্ন গল্পের সমাগম হলো। হঠাত দেখি, একটি ছোট্ট বালক এলো টঙ-এর সামনে। কয়েক মিনিট থাকালো চায়ের দিকে; আবার এক পলক তাকালো হয়তো আমাদের দিকে। চলে যেতে লাগলো, যেদিক হতে সে এলো কয়েক পলক আগে। এই কয়েক পলকে আমি তার চেহারাতে আবিস্কার করলাম কিছু ক্ষুধা, কিছু চাওয়া এবং কিছুটা লজ্জা। যেন তার মাসুম চেহারার ভাঁজে ভাঁজে ক্ষুধা নামক বস্তুটি বসবাস করছে গভীরভাবে। তার চাহনিতে অচ্ছুত হয়ে ফুটে উঠেছে কিছু চাওয়ার তাড়না; কিছু না খাওয়ার বেদনা। তার ফিরে যাওয়ার চলনে, মাটিতে পা ফেলার ধরনে, অভিমানের রেখাপাত জ্বলজ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। তার পায়ের চিহ্নে ক্ষুধার প্রতিচ্ছবি আবিস্কার করতে আমার খুব বেশি দেরি হলো না। তাই উঠে গিয়ে তাকে ডাকলাম। তার ফিরে তাকানোর অবস্থা এবং সেই মূহুর্ত এখনো আমার চোখে, আমার কল্পে ভাস্বর হয়ে ভাসে। চোখের কোণে জলের কণার আবির্ভাব; সেই কণা কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো পায়ে, যখন আমি তার মাথায় বুলিয়ে দিলাম স্নেহসিঞ্চিত হাতের পরশ। আমি তাকে পাশে বসালাম। কী খাবে তুমি? তার উত্তর ” আমি সেই সকাল থেকে কিছুই খাই নি; সকালে মাত্র এক গেলাস পানি খেয়েছি”। এই বাক্য দু’টি বলার ধরণেও ছিল কী যেন এক যাতনা এবং জলপাই রঙের বেদনা। যে বাক্য দু’ টি শোনার জন্য আমি এতোটা প্রস্তুত ছিলাম না। আমার কান শুধু বাক্য দুটি শুনে নি, শোনেছে ক্ষুধার এক জ্বলন্ত ইতিহাস। অনুভব করেছে একটি ভূমিকম্প এবং কর্ণচোখে দেখেছে সাইক্লোনের বিভীষিকা। এ বাক্যে আমার তনুমনে স্তানান্থরিত হলো তার সব বেদনা। আমার মনকে ছেদন করেছে যেন এক মহাশক্তি। মনে হলো, সে সকালে এক গেলাস পানি খায় নি, খেয়েছে এক গেলাস বিষ। নাহ! এক গেলাস বেদনা। পূর্ণ এক গেলাস বেদনা খেয়েছে সে! তাই সে মরে যায় নি; বেঁচে আছে ধুকে ধুকে, যা তার চেহারায় ফুটে উঠেছে দিনের শেষ ভাগেও। তাকে নিয়ে গেলাম খাবার হোটেলে। খেতে দিলাম যা তার মন চায়। খেতে খেতে তাকে অনেক প্রশ্ন করি। উত্তর দিতে গিয়ে বেরিয়ে এলো থরে বিথরে সাজানো বেদনার বেদনা- বিধুর স্তর ও স্তুপ। কতো বেদনা!? এত বেদনা! যেন পুরোটাই বেদনা!!! নাহ! তার জীবনের সিঁড়িগুলি বেদনার স্তরে ও স্তুপে ঢাকা। মা বাবা ছোট ভাই বোনকে নিয়ে ছোট্ট একটি পরিবার ছিলো। বাবা ছিলেন আলেমভক্ত। তাই তাকে পড়তে দিলেন হিফজখানায়। কুরানকে বুকে ধারন করতে, সুললিত কন্ঠে তিলাওয়াত করতে; কুরানের বাহক হতে এবং সুমধুর কন্ঠে মোহিত করতে মানুষের মন। যেমন মুখরিত করেছে বিশ্বের সত্তরটি দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকারকারী, এই বাংলার গর্বিত মায়ের কৃতী সন্তান হাফেজ নাজমুস সাকিব। যথারীতি সে হাফেজ হলো। কিন্তু নির্মম সত্য যে, তার বাবা শাপলা- চত্বরে ঈমানী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে আর ফিরে আসে নি। যেন জীবনের সুখ তার পরিবারের দিকে আর ফিরে তাকায় নি। হয়তো সব সুখ তার বাবা নিয়ে গেছে কোন এক সবুজাভ পরিবেশে। পরিবারের হাল ধরতে এই বালক- শিশু কী পেশা বেছে নেবে? হাফেজে কুরান এবং হামেলে কুরান হওয়ার যে স্বপ্ন ছিল, তার সব স্বপ্ন এখন একটি জমাটবদ্ধ খামে পুরোধার লাশের মতো স্তব্দ ও নিথর। যে আর উঠবে না; যে আর জাগবে না; এবং যে আর ছুটবে না স্বপ্ন- বাস্তবায়নে। তাই এক আলোক স্বপ্ন পেছনে ফেলে আরেক আলোক স্বপ্ন হাতে নিলো! যদিও তা স্বপ্ন ছিলো না; এখন যা আছে, তা আবার দু: স্বপ্নও নয় তার কাছে। কিন্তু বাস্তবতার কাছে, জাতির কাছে তা দু:স্বপ্নই!! সে বেছে নিলো ছোট ভাই বোনের খেদমত। কী চাকরী পাবে সে?! সে তো এখনো শিশু- বালোক! বেছে নিলো সে আরেক কুরানী খেদমত। বাসায় গিয়ে ছেলে মেয়েদের কুরান পড়ানো, যারা তার সমবয়সী বা বয়সে আরো বেশি। কিন্তু দু:খজনক বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজে এখনো তাদের মূল্যায়ন নেই, যারা কুরান পড়ায়, যারা হাদিস শেখায়। কিন্তু কতো মূল্যায়ন, যারা ইংরেজি শেখায়, যারা গণিত কষায়! এই যৎ সামান্য টাকায় সে তার মা, ভাই বোনের মুখে খাবার তুলে দেয়। আফসোস! যে ছেলে এই বয়সে খেলবে, শিখবে, সে আজ খাদ্যের সন্ধানে ঘরে ঘরে, রাস্তায় রাস্তায়। কে যেন বলেছিলো, ক্ষুধা এবং খালি মানিব্যাগ যা শিক্ষা দেয়, হাজারো পাঠ্যবই তা শিক্ষা দেয় না, যদিও তা অম্ল বা কটু। এ রকম হাজারো বাস্তবতা আমাদের সমাজের অলিতে গলিতে বিদ্যমান। যদিও আমরা দেখেও না দেখার ভান করি। সবচেয়ে নির্মম হলো, একজন হাফেজে কুরানের বাস্তবতা। এই দেশে শিশু দিবস আছে। যেদিন বিভিন্ন পয়েন্টে কর্তাবাবুরা সভাও করে, কিন্তু সেখানে সেই শিশুরা স্থান পায়, যাদের বাবা কর্তাবাবুদের নিকটের কেউ। প্রকৃত শিশুরা আড়ালে রয়ে যায়। যেন শিশু দিবস তাদের মনের বেদনা আরো বাড়িয়ে দেয়। তাদের স্থান কোন ফ্লাইওভারের নিচে, বা রেল স্টেশনের প্লাটফরমে অথবা কোন শপিং মলের ফ্লোরে। এই হলো শিশুদের বাস্তবতা। এই দেশে হাফেজদের মূল্যায়ন কতো কম, তা যদি বলা হয়, হয়তো কম শব্দটিও লজ্জিত হবে। কারণ কম শব্দটিও তা ধারণ করে না। আরো কম, বেশি কম; যেন নেই। বাংলাদেশে কি এই রকম হিরো আছে, যে বিশ্বের সত্তরটি দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে? দেশকে আলোকিত করেছে বিশ্বসমাজের মাঝে? আরো তা বিশ্বসভ্যতার মূলনীতি যেখানে বিদ্যমান, তা সুললিত কন্ঠে পাঠ করতে। দেখে দেখে নয়, মুখস্ত বরং ঠোটস্থ। সেই হিরো তো আমার বাংলাদেশের নাজমুস সাকিব এবং হাফেজ যাকারিয়া। বাংলাদেশ সরকার কী মূল্যায়ন করেছে তাদের! শুধু এই সরকার নয়, বরং কোন সরকারই হাফেজদের মূল্যায়ন করে নি রাষ্ট্রীয়ভাবে। অথচ এই দেশে একটি চার- ছক্কার জন্যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। তা খবরের কাগজে লীডনিউজ হয়। একজন সিনেমা নায়কের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করে সরকার। বিনোদন এর বিপক্ষে আমি নই, তবে সুস্থ বিনোদন মানুষের মনে প্রাণন সৃষ্টি করে। কিন্তু কুরানের কেন নায়কদের এই অবস্থা?! অথচ তারাই বাংলাদেশকে বিশ্বের মাঝে তুলে ধরে কুরানী হাফেজ তৈরির প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে। সুমধুর কন্ঠে তিলাওয়াত করে মানুষের ঈমানে স্পন্দন সৃষ্টি করে। সুললিত কন্ঠে মানুষের মনে প্রাণন জাগায়। ঘুণে ধরা অন্তরে আলোর ফানুস জ্বালিয়ে দেয়। লেখক : ছাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply