তোফায়েল আহমদ:
গুজবে কান দিবেন না। যে কোন ধরনের গুজব রটানোর সাথে সাথেই এ রকম পরামর্শ দেয়া হয়। তবে কিছু কিছু গুজবে কান দিতে হয়। তাও যদি হয়-‘স্পর্শকাতর গুজব’। আমি মনে করি সীমান্তে ছড়ানো গুজবটি ছিল-অত্যন্ত ষ্পর্শকাতর। তাই এটাতে কান দেয়া দরকার। এ গুজবটি ছড়ানো হয়েছিল গত সোমবারের ঈদের আগের দিন রবিবার। গুজব ছিল-বর্মার আরাকান রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় যদি সোমবারের ঈদের নামাজ পড়তে দেয়া না হয় তাহলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনদের ওপর হামলা চালানো হবে। হামলা চালাবে বর্মার বিদ্রোহী জঙ্গী সংগটন ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন’র (আরএসও) সদস্যরা। গুজবে সঙ্গত কারনেই প্রশ্ন উঠতে পারে- রোহিঙ্গাদের ঈদের নামাজ পড়তে বাধা দিচ্ছে বর্মার সরকার। এ কারনে রোহিঙ্গা এবং তাদের নানা সংগটন ক্ষুব্দ হতে পারে-এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাথে কি সম্পর্ক বা তাদের উপর ক্ষোভ এবং হামলার কথা আসবে কেন ?
এসব কথার জবাবের আগেই নিরাপত্তাজনিত কারনে লোকজন ঘর ছাড়তে শুরু করে দেয়। উখিয়ার কুতপালং ও পার্শ্ববর্তী নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকায় গুজবটি যেন ঘুর্নিঝড়ের আকস্মিক প্রচন্ড বেগে বয়ে যায়। গ্রামের অশিক্ষিত লোকজন বিশেষ করে নারি ও শিশুরা ঈদের সেই আগের রাতটি নিরাপদে কাটানোর জন্য ঘর ছেড়ে আশ্রয় নেয় অন্যত্র। কুতুপালং গ্রামের বাসিন্দা এবং স্থানীয় তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হক খান জানান, ব্যাপারটি গুজব হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেই তারা তাৎক্ষনিক পাড়ায় গিয়ে লোকজনদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষনে বড়–য়া পাড়ার অনেক বাসিন্দা নিরাপত্তাজনিত কারনে আশ্রয়ে গেছেন অন্যত্র। বড়–য়া পাড়ার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গও উৎকন্ঠিত হয়ে পড়েন। বৌদ্ধ সমিতির সভাপতি রবীন্দ্র বড়–য়া দ্রুত পুলিশে সংবাদ জানান।
বিষয়টি নিয়ে গতরাতে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পরিদর্শক (তদন্ত) নিলু বড়–য়া জানান, ঘটনাটি আসলে গুজব হলেও ষ্পর্শকাতরতো বটেই। তিনি এমন সংবাদ পাবার সাথে সাথেই রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হন যে-গুজব গুজবই। তবু বড়–য়া পাড়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। গোয়েন্দা কর্মীরাও জানান, এ ধরনের গুজবটি সেদিন রটানো হয়েছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবেই। উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আরো জানান, ব্যাপক অনুসন্ধানের পর ইতোমধ্যে গুজবের নেপথ্য নায়কদের খোঁজ মিলেছে। কুতুপালং গ্রামের বাসিন্দা পরেশ বড়–য়া হচ্ছে মূল নেপথ্য নায়ক। তার সাথে রয়েছে আরো কয়েকজন। এক সময় যানবাহনের চালক ছিলেন এই পরেশ। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে থানার পরিদর্শক জানান-এটা টের পেয়ে তারা গা ঢাকা দিয়েছে।
সীমান্ত এলাকার লোকজনের দেয়া তথ্য মতে- পরেশ বর্মী সরকারের একজন খাস লোক হিসাবে পরিচিত। প্রায়শ বর্মায় যাওয়া আসা রয়েছে তার। তিনি কুতুপালং গ্রামের বাড়ী-ভিটিও বিক্রি করে দিয়েছেন ইতোমধ্যে। এই পরেশ বড়–য়া বিগত কিছুদিন ধরে স্থানীয় বড়–য়াদের নিকট বর্মায় ‘অত্যন্ত সুখ-শান্তির’ প্রচার করে আসছিলেন। গ্রামের বড়–য়াদের তিনি উৎসাহিত করে আসছিলেন-বর্মায় পাড়ি জমাতে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ নাকি তাকে বলেছে-সেখানে বড়–য়া (বৌদ্ধ) সম্প্রদায়ের লোকজন গেলে তাদের বিপুল পরিমাণের জায়গা-জমি ও ঘরবাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। অন্তত ২০/৩০ টি পরিবার বর্মায় নিয়ে যাবার জন্য এই পরেশ নিরবে কাজ চালিয়ে আসছিল। ব্যাপারটা এরকম যে-বর্মার রোহিঙ্গা নেতারা যেমনি সাধারন রোহিঙ্গাদের এপাড়ে আনতে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে তেমনি এপাড়ের বৌদ্ধদেরও বর্মায় নিয়ে যাবার প্রলুব্ধ করা হচ্ছ্ ে। আর পরেশদের সর্বশেষ প্রচেষ্টা ছিল যদি কিনা এরকম গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে হয়তোবা তার মিশন কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
এরকম গুজবের কারনে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছেন-বর্মা কর্তৃপক্ষ তাদের সৃষ্ট রোহিঙ্গা ইস্যুকে কিছুটা হলেও কভার করার জন্য বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘু বড়–য়াদের (বৌদ্ধ সম্প্রদায়) তাদের দেশে শরনার্থী হিসাবে নিতে চান। বাংলাদেশের পরেশ বড়–য়াদের এক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে হয়তোবা। বর্মী কর্তৃপক্ষের নির্যাতনে সেদেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা এপাড়ে ধেয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। গত সোমবারের ঈদের নামাজও রোহিঙ্গাদের আদায় করতে দেয়া হয়নি। এ কারনে প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গা তুমবুরু-ঘুনধুম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের ঈদ জামায়াতে অংশ নিয়ে আবার ফিরেও গেছে নিজ দেশে। রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের কারনে বর্মা সত্যিকার অর্থে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক বিশ্বের চাপের মুখে নেই। কেননা বর্মায় রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু মুসলিম। তবে যদি কিনা সেখানে আজ বৌদ্ধধর্মাবলম্বরী সংখ্যালঘু হয়ে রোহিঙ্গাদের হাতে নির্যাতিত হত তাহলে হিলারি ক্লিনটনরা কি করতেন এটা বলার দরকার পড়ে না। তবুও সীমান্তের এরকম ‘ষ্পর্শকাতর গুজব’ নিয়ে হেলাফেলার কোন সুযোগ নেই। এরকম গুজবে সংগত কারনেই ধারণা জন্মেছে যে-বর্মা থেকে সে দেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা নির্যাতনের কারনে এদেশে যেমনি পাড়ি দিচ্ছে তেমনি রোহিঙ্গা জঙ্গীদের নির্যাতনে এপাড়ের সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনও বর্মায় পাড়ি দিচ্ছে মর্মে তাদের (বর্মা)এরকম একটা কিছু দরকার। তাই কিছু লোকজন যদি তারা এরকম পেয়ে যায় আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায়ও ফলাও প্রচার করা যাবে। আবার এরকম গুজব অদুর ভবিষ্যতেও যাতে কোন দিন বাস্তবে রূপ না নেয় সেদিকেও লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন। তাই সাধু সাবধান।
Leave a Reply