টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম অংশে এক কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে ১০টি গ্রাম নিয়মিত প্লাবিত হচ্ছে। কাঁটাবুনিয়া এলাকায় কয়েক শ একর ফসলি জমি জোয়ারের পানিতে ডুবে রয়েছে। টেকনাফ থেকে সড়কপথে শাহপরীর দ্বীপ যাতায়াতের পাকা সড়কটি জোয়ারের পানিতে ডুবে আছে।লোকজনকে শাহপরীর দ্বীপে যেতে হচ্ছে গাড়ির বদলে নৌকায় চড়ে। স্থানীয় লোকজনের জিজ্ঞাসা, তাহলে শাহপরীর দ্বীপ কি আর টেকনাফের সঙ্গে জোড়া লাগবে না? সারা জীবন নৌকা নিয়ে চলাচল করতে হবে?সম্রাট শাহ সুজার নামের ‘শাহ’ আর তাঁর স্ত্রী পরীবানুর ‘পরী’ নিয়ে ছোট্ট দ্বীপটির নামকরণ হয় ‘শাহপরীর দ্বীপ’। নারকেল, সুপারি, পান আর লবণ উৎপাদনের প্রসিদ্ধ এলাকায় প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বাস। প্রতি বছর কয়েক শ কোটি টাকার সামুদ্রিক মাছ এই দ্বীপ থেকে সারা দেশে জোগান দেওয়া হচ্ছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কাছাকাছি হওয়ায় ইতিমধ্যে শাহপরীর দ্বীপ পর্যটকের নজর কাড়ছে।
শাহপরীর দ্বীপ রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বলেন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে এই দ্বীপের পশ্চিম অংশে (পশ্চিম পাড়ায়) এক কিলোমিটারের মতো বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এর পর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ওই ভাঙা অংশ সংস্কারের জন্য ৭০ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এই ভাঙা অংশে বেড়িবাঁধ তৈরি হয়নি, বরং এই কয়েক বছরে বেড়িবাঁধ ভেঙে দ্বীপের পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়া, মাঝরপাড়া, ঘোলাপাড়া, বাজারপাড়া, জালিয়াপাড়াসহ ১০ গ্রামের কয়েক হাজার একর ফসলি জমি সমুদ্রে বিলীন হয়েছে। ভেসে গেছে তিন শতাধিক ঘরবাড়ি। এখনো কয়েক হাজার একর ফসলি জমি জোয়ারের পানিতে ডুবে দ্বীপটিকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
হাজী বশির আহমদ উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাওলানা ফরিদুল আলম বলেন, পাকা সড়কটি জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকায় এই দ্বীপের লোকজন টেকনাফ সদরে যেতে পারছেন না। বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় অসুস্থ নারী-শিশুদের টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো যাচ্ছে না। গত কয়েক দিনে পাঁচ-ছয় জন নারী-শিশুর মৃত্যু হয়েছে। স্কুল-কলেজপড়ুয়া শতাধিক ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ২৫ দিন ধরে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০ জুলাই জোয়ারের পানিতে ‘কক্সবাজার-টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ’ সড়কের ভরাখালে একটি কালভার্ট ভেঙে যায়। এর দুই পাশে বিশাল সড়ক বিলীন হয়। পাশাপাশি আরও তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার পাকা সড়ক লোনা পানিতে ডুবে থাকে। এতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এ কারণে দ্বীপের ২৫ হাজার মানুষের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। জোয়ারের পানিতে ডাঙ্গরপাড়া, পশ্চিমপাড়া, মাঝরপাড়া, দক্ষিণপাড়া, ঘোলাপাড়া, হারিয়াখালী ও কাঁটাবুনিয়া গ্রামের বাড়িঘর, পানবরজ, সুপারি বাগান ও বীজতলা ডুবে গেছে।
টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়কের রিকশাচালক নুর কালাম (৩৪) বলেন, ‘১৫ দিন ধরে আয় রোজগার বন্ধ। কারণ, জোয়ারের পানিতে সড়কটি ডুবে রয়েছে। ঈদে ছেলেমেয়েদের জামাকাপড়ও কিনে দিতে পারিনি।’
নৌকাচালক আবদুল হামিদ (৪৫) বলেন, যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় নৌকা দিয়েই লোক পারাপার করতে হচ্ছে। আয় রোজগারও ভালো হচ্ছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর নৌকা চলাচল বন্ধ হলে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে।
মিস্ত্রিপাড়ার জেলে নুরুল ইসলাম ( ৪৬) বলেন, ‘সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় অসুস্থ মাকে টেকনাফ সদর হাসপাতাল নিতে পারছি না।’ স্থানীয় কলেজছাত্র জাকারিয়া আলফাজ বলেন, সামান্য বেড়িবাঁধ নির্মিত না হওয়ায় পুরো দ্বীপটি প্রায় এক মাস ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এতে মানুষের চরম দুর্ভোগ যাচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজের) টেকনাফের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আবদুর রশিদ বলেন, জোয়ারের পানি সরে না যাওয়ায় ভাঙা সড়ক ও কালভার্টের সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না। জোয়ার ঠেকাতে গেলে আগে ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কার দরকার।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মঈনুদ্দীন বলেন, শাহপরীর দ্বীপের ভাঙা বাঁধটি জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়। চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ভাঙা বাঁধে বালুর বস্তা ফেলা হয়। কিন্তু জোয়ারের ধাক্কায় এই বস্তা ভেসে যায়। সাগরের উত্তাল পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এই ভাঙা বাঁধ নির্মাণ সম্ভব নয়।
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাংসদ আবদুর রহমান বদি বলেন, দুই বছরে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম অংশের এক কিলোমিটার স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য সরকার প্রায় ১৮ কোটি টাকা খরচ করে। কিন্তু বালুর বাঁধ দেওয়ায় এই বেড়িবাঁধ বারবার ভেঙে যাচ্ছে। গত ২০ বছরে এই এক কিলোমিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ৬০-৭০ কোটি টাকা খরচ করা হলেও শাহপরীর দ্বীপের ৪০ হাজার মানুষ বেড়িবাঁধ পায়নি। এখন কোনো মতে ভাঙা বাঁধ ঠিক করে শাহপরীর দ্বীপকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জোড়া লাগানোর চেষ্টা চলছে।
Leave a Reply