টেকনাফের অবশেষে স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে এলাকাবাসী। বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এই জনপদটি মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বেড়িবাঁধ বিলীন হওয়ার প্রেক্ষিতে শাহপরীরদ্বীপের পশ্চিম, পূর্ব ও উত্তরাংশে নিয়মিত জোটারভাটা চলছে। যোগাযোগের সড়কটি প্রায় ৪ ফুট পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় মানুষ নৌকাযোগে পারাপার করছে। বর্তমানে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার পূর্বপাশের একাংশের বেড়িবাঁধের ভাঙনে গোটা শাহপরীরদ্বীপ বিলীন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে শাহপরীরদ্বীপ জালিয়াপাড়া এলাকার মানুষ আতংকগ্রস্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জালিয়াপাড়া এলাকার অবস্থা খুবই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সরকারপক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোন প্রকার ত্রাণের ব্যবস্থা হয়নি। তাই এলাকার মানুষ নিজ উদ্যোগে বাঁধ নির্মাণ করতে শুরু করেছে। ডাংগার পাড়া ও উত্তর পাড়া বেড়িবাঁধ ভাঙনের ফলে জালিয়াপাড়া এলাকার প্রায় ৪ শ পরিবার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। পর্ূর্ণিমা ও অমাবস্যা জো মৌসুমে পানিবৃদ্ধির ফলে জালিয়াপাড়া এলাকা ডুবে যায়। এতে এলাকার জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সরেজমিনে শাহপরীরদ্বীপের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, জোয়ারের পানিতে বিভিন্ন স্থানে বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, চিংড়িঘের, পানবরজ, সুপারিবাগান ও ফসলের বীজতলা ডুবে গেছে। বিশেষ করে টেকনাফে শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, পশ্চিমপাড়া, মাঝেরপাড়া, দক্ষিণ পাড়া, ঘোলাপাড়া, টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়ক জোয়ারের পানিতে ভরাখাল -উত্তরপাড়া পর্যন্ত ডুবে আছে। এমন কি শাহপরীরদ্বীপ-টেকনাফ সড়ক প্রায় ৪ ফুট পানিতে নিমজ্জিত। এতে যোগাযোগ এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। প্রয়োজনের তাগিদে স্থানীয় বাসিন্দারা নৌকা নিয়ে দুর্ভোগের মধ্যে পারাপার করছে। এদিকে সংশ্ল্লিষ্ট এলাকার গ্রামগুলোতে পানি ঢোকায় অধিকাংশ লোকজন উঁচুস্থানে আশ্রয় ও কক্সবাজার, চট্টগ্রামে বিভিন্ন আত্নীয়-স্বজনদের বাড়িতে চলে গেছে। যার ফলে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে অংসখ্য বাড়িঘর সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে গৃহহারা হয়ে লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। পানিতে মূল্যবান জিনিসপত্র ও লাখ লাখ টাকার জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া এলাকা যেন এখন মানবশূন্য এলাকায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে মাটির তৈরি ঘরগুলো ধসে গেছে। অথচ এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে কোন ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। বিত্তবানেরাও গা ঢাকা দিয়েছে। আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকলেও লোকসংখ্যা অনুপাতে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। সাইক্লোন শেল্টারের দক্ষিণে বেড়িবাঁধে ব্যাপক ভাঙন ধরেছে। বেড়িবাঁধ সড়কটি টেন্ডার হওয়ার পরে কাজ শুরু করে সমাপ্ত না করায় রাস্তাটি ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কারণে বেড়িবাঁধেও ভাঙন শুরু হয়েছে। জালিয়াপাড়া মসজিদ, মাদ্রাসা, আনন্দ স্কুল সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে বিলীন হয়ে গেছে। চলাচলের কোন রাস্তা নেই। টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের জনসাধারণ আশান্বিত ছিল মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসলে অবশ্যই বেড়িবাঁধের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হবে । কিন্তু এক নিমিষে তলিয়ে গেছে যেন অত্র এলাকার মানুষের সব কিছু। শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া গ্রামের জেলে আবদু শুক্কুর হতাশ হয়ে বলেন, রমজান মাসের শেষে ঈদ আনন্দ আমাদের কাছে নিষ্ফল হয়ে গেছে । এদিনে ঘরে জোয়ারের পানি ঢুকে রান্নাবান্না করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রমজানের সময় সেহরি-ইফতার করা দুঃসাধ্যের মধ্যে গেছে। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘরের ভেতর মাচা বেঁধে বসবাস করছি। এ দুদর্শা কবে আমাদের কপাল থেকে মুছে যাবে, এ প্রশ্ন । একই গ্রামের ছৈয়দ আলম বলেন, ক’দিন আগেও এখানে আরও ২০-৩০টি বসতবাড়ি ছিল। বেড়িবাঁধের ভাঙনের কারণে তারা অন্যত্র চলে গিয়েছে। দিনের বেলায় জোয়ারের পানি কোনোমতে সামলানো যায়। কিন্তু রাতে জোয়ার এলে কোথায় আশ্রয় নেব, সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র থেকে জানা যায়, বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদীর দুইটি পৃথক স্থানে বেড়িবাঁধ ভাঙনের ফলে জোয়ারের পানিতে শাহপরীরদ্বীপ এলাকার অধিকাংশ গ্রামের বসতবাড়ি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় আরও একাধিক স্থানে নতুন করে বেড়িবাঁধ ও সড়ক ভেঙে গেছে। এতে করে এসব এলাকায় অসংখ্য বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, ধানের বীজতলা ও চিংড়িঘের পানিতে ডুবে গেছে।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আবদুস সালাম বলেন, বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন বেড়িবাঁধের ভাঙনকৃত অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে মসজিদ ও বসতবাড়িসহ ২০-৩০টি বাড়ি সাগরের বিলীন হয়ে গেছে। পাশাপাশি জোয়ারের পানিতে অধিকাংশ বাড়িঘর ডুবে থাকায় অন্য এলাকার আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এমতাবস্থায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া না হলে এ বর্ষা মৌসুমে অধিকাংশ এলাকা বঙ্গোপসাগরের করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে যাবে। পূর্বের একমাত্র বেড়িবাঁধটিতে সামান্য ভাঙন ধরলে গোটা জালিয়াপাড়া এলাকা বিলীন হয়ে যেতে পারে। তিনি আরো জানান, সাগরের ভয়াবহ ভাঙনে বসতভিটা সাগরে বিলীন হয়ে যাওয়ায় আতংকিত এলাকাবাসী তাদের বসতভিটা রক্ষার্থে গত ২৩ আগস্ট থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। প্রতিদিন চলছে বাঁধ নিমার্ণ কাজ । শাহপরীরদ্বীপ উত্তর পাড়ার ব্যবসায়ী মুহিব উল্লাহ জানান, বেড়িবাঁধ ভাঙনের ফলে শাহপরীরদ্বীপের বিভিন্ন অংশ যেভাবে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, এতে তারা চরম দুশ্চিন্তায় আছে কোন সময় সম্পূর্ণ শাহপরীরদ্বীপ বঙ্গোপসাগর গ্রাস করে ফেলে। পাউবো টেকনাফ অঞ্চলের উপ-সহকারি প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন বলেন, বর্ষা মৌসুমে বেড়িবাঁধে কোন সংস্কার কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বেড়িবাঁধে নতুন নতুন ভাঙন সৃষ্টি হওয়ায় নাফনদী ও বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন এলাকাগুলো প্লাবিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়াদি উল্ল্লেখ করে পানি উন্নয়ন বের্াডে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিক মিয়া বলেন, এ উপকূলীয় উপজেলায় মানুষ দীর্ঘ ছয় বছর ধরে পূর্ণিমা, অমাবস্যার জোয়ার ও পাহাড়ি ঢলের সাথে যুদ্ধ করে আসছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার তিনটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে অন্তত আট হাজার পরিবারের প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষকে প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটায় বসবাস করতে হচ্ছে। শাহপরীরদ্বীপের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার নুরুল আমিন জানান, অসময়ে কাজ করার ফলে এই মরণদশা হয়েছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা ৭৫ লক্ষ টাকার টেন্ডার নেওয়ার পরেও মাত্র দুই থেকে তিন লক্ষ টাকার বালু দিয়ে কাজ করার ফলে শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিম-মাঝের পাড়ার স্লুইস গেট থেকে উক্ত বালু দিয়ে নির্মিত বেড়ি বাঁধ ভেঙে সাগরের পানি ঢুকে আগের তুলনায় ক্ষয়ক্ষতি অত্র এলাকায় বেশি হয়েছে এবং ঘরবাড়ি ফেলে মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট ও অভাব দেখা দিয়েছে।
Leave a Reply