এবারের ঈদে ৭ থেকে ৮ দিন ছুটি। কেউ হয়তো নিজ বাড়িতে ঈদের ছুটি কাটাবেন। আবার অনেকে ভাবছেন ঈদের ছুটিতে কোথায় যে যাওয়া যায়। কক্সবাজারকে নিয়ে অনেকেই তো ভাবেন, কিন্তু সময়ের অভাবে সেখানে যাওয়া হচ্ছে না। তারা এবারের ঈদের ছুটির কয়েকটা দিন কাটাতে পারেন কক্সবাজার আর টেকনাফে। আহা! কী ই না বিশাল সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে। বঙ্গোপসাগরের জলরাশি মুহূর্তে মুহূর্তে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা। কাছ থেকে সমুদ্র দেখা; সমুদ্র তীরে বসে থাকা; উত্তাল ঢেউ দেখা; বালুরাশিতে দুপা রাখা; পদযুগল ভিজিয়ে যাওয়া— এমনটি মেলে শুধুই যে কক্সবাজারে। প্রেমিক মন কখনও উতলা হয় কক্সবাজারে এলে। মনে পড়ে তখন— ‘ওগো মোর গীতিময়, মনে নেই, সে কি মনে নেই, সেই সাগর বেলায় ঝিনুক খোঁটার ছলে গান গেয়ে পরিচয়’ কিংবা ‘ঐ যে হোথায় সাগর বেলায় ঢেউ করে কানাকানি…ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায় মুছে যায় বারে বারে’ গানের কত না কথা!
আমাদের দেশে পর্যটনের প্রধান শহর ‘কক্সবাজার’। থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সবদিক দিয়েই সুবিধাজনক স্থান এই কক্সবাজার। শুধু সমুদ্র নয়, পাহাড় আর অরণ্য দেখা মেলে এখানে। বালুকা বেলায় ঘোড়ার পিঠে চড়াও যাবে, হাতির পিঠে উঠে দু’নয়ন ভরে দেখা যায় সমুদ্র। সূর্যোদয়ের চেয়ে কক্সবাজারে কী সমুদ্রে, কী সৈকতে সূর্যাস্তের রূপ, রং লাবণ্য অনেক বেশি জ্বল জ্বল করে। সূর্য ডোবা না পর্যন্ত তাই অপেক্ষা করতে হবে সৈকতে। সন্ধ্যার পর সমুদ্র তীরে বসে থাকলে আরেক রূপ খুঁজে পাবেন। দেখবেন, ওই যে আকাশে চাঁদ। তখন হয়তো মনে পড়বেই—‘তোমায় দেখেছি তন্দ্রাবিহীন রাতের তারায় মেঘের বরণ চাঁদের ইশারায়…’ গানের এ কথাগুলো। শুধু কী তাই, আরও মনে পড়বে : ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড় তারই মাঝে প্রেম যেন গড়ে খেলাঘর’, ‘আমি আল্পনা এঁকে যাই আলোয় ছায়ায়’, ‘আকাশে লক্ষ তারার খেয়ালি পলাশের বনে রঙের হেয়ালি’, ‘ময়ূর পঙ্খী ভেসে যায় রামধনু জ্বলে তার গায়’ এমনই কত না গানের কথা।
সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে আপনারও জানতে ইচ্ছে হবে, কক্সবাজার দেখা শেষ করে এবার কোথায় যাওয়া যায়। মনে রাখবেন এই জেলার রামু, উখিয়া, চকোরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া—এগুলোও উপজেলা। এর যেখানেই যান না কেন, ঘুরে ফিরে প্রবল আনন্দ পাবেন। শুধু তাই নয়, কক্সবাজারের হ্নীলা, সেন্টমার্টিন,, বাহারছড়া, হোয়াইকং, পালংখালী, রাজাপালং, রতনা পালং, হালদিয়া, খুনিয়া, রাজারকুল, সাউথ মিঠাছড়ি, ফতেকারপুল, ঝিনলজা, গোরকঘাটা, শাপলাপুর, ধলঘাটা, দুলাহাজারা প্রভৃতি জায়গাও আকর্ষণীয়। সময় পেলে ছুটে যাবেন কক্সবাজারের এসব জায়গায়। এই কক্সবাজার জেলায় দর্শনীয় স্থান আরও আছে যেমন— প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, ইনানী সমুদ্র সৈকত, আদিনাথ মন্দির, মাথিনের কূপ, রামুর বৌদ্ধ মূর্তি, মন্দির, হিমছড়ি, শাহ ওমরের শরীফ, কানাবাজারের ভূগর্ভস্থ খাল প্রভৃতি।
যেখানে থাকবেন : কক্সবাজারে রয়েছে হোটেল-মোটেলের ছড়াছড়ি। যেমন-হোটেল সায়মন, হোটেল প্যানোয়া, হোটেল পালংকী, হোটেল সী কুইন, মোটেল সৈকত, প্রবাল, উপল, হোটেল বিচ, হোটেল বনানী, হোটেল মারমেড, হোটেল হলিডে, হোটেল সাগরগাঁও, আল হিরা ইন্টারন্যাশনাল, সি বার্ড, সি হেভেন প্রভৃতি। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আছে প্রতিটি হোটেলে। যদি মনে করেন বাইরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবেন তাহলে খেতে পারেন— রজনী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে, সজনী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, নাহার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, ডায়মন্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুেরেন্ট কিংবা অন্য কোনো রেস্টুরেন্টে। মিষ্টি খেতে চাইলে যাবেন-মধুবন, বৈশাখী নয়তো মিষ্টান্নে।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে কক্সবাজারে আকাশপথে বিমানে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সড়কপথে যায়— সৌদিয়া, বোরাক, বাগদাদী, সোহাগ, এস আলম, শ্যামলী, গ্রীন লাইন, হানিফ প্রভৃতি পরিবহন।
ঈদে কক্সবাজার দেখে টেকনাফে : ঈদে একবার কক্সবাজারে বেড়ানোর কথা এখনও ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে। চাঁদ রাতে রওনা হলাম আমি আর সজীব। সোহাগ পরিবহনে উঠে খুব ভোরে এলাম কক্সবাজারে। উঠলাম পর্যটনের মোটেল প্রবালে। প্রতিদিনের মতো সকালের কাজগুলো সেরে আমি ও সজীব এলাম সমুদ্রতীরে। হেঁটে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল বহুতল ভবনের একটি আবাসিক হোটেল। সমুদ্র সৈকত ঘেঁষে এটি গড়ে ওঠায় দেখে মনে হলো সাগরের রূপ ও সৌন্দর্য যেন ম্লান করে দিয়েছে। সজীব বলল, কেউ কী আইন মানে! পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক একটু হেসে আইন তো গরিবের জন্য। বড়লোকের জন্য নয়। বড় লোকরা যে যেভাবে পারে সেভাবেই জায়গা দখল করে কক্সবাজারের সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছে। দেখি একটি তেরো বছরের ছেলে বকুল ফুলের মালা নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল, মালা বিক্রি করে যা পাই তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। দশ টাকার একটি নোট দিতেই তা নিয়ে ছেলেটি চলে গেল সমুদ্রের তীরঘেঁষে। দেখছি, ওই যে যাচ্ছে। হঠাত্ টেলিফোন বেজে উঠল। অপরপ্রান্ত থেকে আমি নাঈম বলছি, আজকে টেকনাফে আসছেন তো!’ বললাম, কাল সকালে..। কথাটা শেষ না হতেই নাঈম বলল, কথা যেন ঠিক থাকে। দুপুরে প্রবাল মোটেলের রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাওয়া-দাওয়া সেরে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিলাম। বিকাল ৪টার দিকে রওনা দিলাম মহেশখালী দ্বীপের দিকে, রিকশায় তারপর তো স্পিডবোটে উঠে চলে এলাম মহেশখালীতে। নেমেই দেখি রিকশা আর রিকশা। একজন চালককে বললাম আদিনাথ মন্দির যাব, কত নেবে? উত্তর—খুশি হয়ে যা দেন। আরেক রিকশাওয়ালা বলল, উঠুন ত্রিশ টাকা দেবেন। এই নিয়ে দু’জনার মধ্যে বেশ তর্কবিতর্ক চলল। পরে একটু এগিয়ে অন্য রিকশা ধরে এলাম আদিনাথ মন্দিরের কাছে। পাহাড়ের গায়ে এ মন্দির দেখে বার বার তাকিয়ে রইলাম। সজীব বলল, ‘ওগো না তোমার দুয়ার নাকি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে’। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম উপরে। পাহাড়ের একপাশে এসে বসলাম। চোখে পড়ল মহেশখালীর বাঁক। যেদিকে তাকাই শুধুই সবুজের ছোঁয়া। এক ঘণ্টা কাটিয়ে নেমে এলাম নিচে। একটু এগিয়ে নৌকো পেলাম। নৌকোয় উঠে চললাম কক্সবাজারের দিকে। মধ্যপথে আসতেই দেখি সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সজীব হাতটা স্পর্শ করে বলল, দেখুন ওই যে চাঁদ…। ঈদের এ চাঁদ তো গতকালও আসার পথে দেখেছি। বার বার তাকিয়ে আছি চাঁদের পানে, তখন হৃদয়ে জেগে উঠল : রমজানের দিন শেষে এলো কি মোর চাঁদ হেসে/তাই পথ চাওয়া প্রেম হাসে মধু আঁখি জলে/বুঝি মোর প্রিয়তম এলো বলে/ঈদের চাঁদ হেরি নভোতলেরে হিয়া দোলেরে’ গানের এ কথাগুলো।
কক্সবাজারে একরাত কাটিয়ে পরদিন এলাম টেকনাফে। বাস থেকে নেমেই দেখি ‘নাঈম,’। বুকে জড়িয়ে ঈদ মোবারক জানাল। সঙ্গের ছেলেটাকে বলল, তুই যা লাগেজগুলো বাসায় রেখে আয়। মাথিনের কূপ দেখেই ফিরব আমরা। ওখানে গিয়ে ধীরাজ ভট্টাচার্যের নামটি দেখে তারই কথা মনে হলো। ১৯২৮ সালে যৌবনের প্রথম দিকে ধীরাজ এই টেকনাফে আসেন তখন তার সঙ্গে মন দেয়া নেয়া হয় মাথিনের। দুর্ভাগ্য ওদের মিলন হলো না। ধীরাজও চলে গেল কলকাতায়। মাথিন কিছুতেই পারেনি প্রেমিক ধীরাজের কথা ভুলতে। এক সময় পৃথিবীতে ওর বেঁচে থাকতে আর মন চাইল না। শেষতক কূপে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল মাথিন। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম মাথিনের কূপের দিকে। সেই ক্ষণে মাথিনের প্রেমিক ধীরাজ ভট্টচার্য অভিনীত-বাসবদত্তা, বিদেশিনী, অভিনয়, দক্ষযজ্ঞ প্রভৃতি ছবির কথা বার বার মনে পড়ল। সেদিন রাতে ছিলাম নাঈমের বাড়িতে। পরের দিনও থাকতে হলো। সন্ধ্যার পরে এলাম নাফ নদীর তীরে— কাছ থেকেই দেখলাম মিয়ানমার নামের দেশটি। তখন সজীব বুকে জড়িয়ে ধরলো…। কত টাকা খরচ পড়বে : কক্সবাজার আর টেকনাফে একত্রে দু’জন বেড়াতে গেলে খরচটা কম পড়বে। দুই রাত থাকুন কক্সবাজারে, একরাত না হয় কাটাবেন টেকনাফে। হোটেলে ভালো পরিবেশে থাকতে চাইলে রুম ভাড়া একটু বেশি পড়বে। ভালো হোটেলে থাকা মানে পরিচ্ছন্ন খাবারও মিলে যাওয়া। আর এ জন্য দু’জনের যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য খরচ পড়বে প্রায় ১২ হাজার টাকা।
Leave a Reply