রোহিঙ্গা সমস্যা মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যকার ধর্মীয় সংঘাত নয়, এটা হলো নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিষয়। আমাদের খুবই হুঁশিয়ার থাকতে হবে।’
—সুরিন পিতসুয়ান, আসিয়ান জোটের সেক্রেটারি জেনারেল
বিশ্বব্যাপীই সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সংঘাতের ঢল দেখা যাচ্ছে। পূর্ব ইউরোপের বলকান যুদ্ধ থেকে যাত্রা করে ভূমধ্যসাগর তীরের আরব অঞ্চল হয়ে সেই সংঘাত ইউরোপ-আমেরিকায়ও চাঙা হচ্ছে। হিংসার ঢল হালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও পৌঁছেছে। গত জুনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী সাম্প্রদায়িকতায় অনেক প্রাণ গেছে, উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। তারপর আসামে বাঙালি মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা এল। এরপর রামুতে হলো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মস্থানে বর্বর আক্রমণ। এরপর আবারও শিকার হচ্ছে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানেরা। সব কটি ঘটনাতেই কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমস্যাটা তাই নিছক সামাজিক সাম্প্রদায়িকতা নয়, ইতিমধ্যে এটা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা-ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট আসিয়ান-প্রধানও সেদিকেই নজর কেড়েছেন।
গত ৩০ অক্টোবর আসিয়ানের সেক্রেটারি জেনারেল সুরিন পিতসুয়ান হুঁশিয়ারি করেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর চলছে অসহনীয় চাপ, যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ। আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই চাপ ও যন্ত্রণা দূর করতে না পারলে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা চরম পন্থার দিকে যাবে। তা হলে মালাক্কা প্রণালি থেকে শুরু করে সমগ্র অঞ্চলটিই অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।’ ইতিমধ্যে ব্রিটেনের অর্থপুষ্ট মুসলিম এইড এবং সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত এনজিওগুলো রোহিঙ্গা কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়োজিত। অন্যদিকে সৌদি আরবের মদদে বিক্ষুব্ধ রোহিঙ্গাদের একটি অংশ জঙ্গি প্রশিক্ষণ পাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
মালাক্কা প্রণালি দুনিয়ার বাণিজ্যিক চলাচলের উল্লেখযোগ্য অংশ। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগ হলো এই প্রণালি। ভারত, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বাঘা বাঘা অর্থনৈতিক শক্তি এই নৌপথের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। এই অঞ্চল ঘিরে রয়েছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ জনসংখ্যার দেশগুলো। খ্রিষ্টান ছাড়া বাকিদের প্রত্যেকেরই জনসংখ্যা শতকোটির ওপর। আবার ভারত মহাসাগরে সামরিক প্রাধান্য বজায় রাখা এবং এশীয় অঞ্চলে চীনকে হটিয়ে প্রাধান্য বিস্তার করা এখন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত উদ্দেশ্য ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মসূচি।
আসিয়ান-প্রধান আরও বলেছেন, ‘এই অঞ্চলটি সহিংসতার ঝুঁকিতে নিপতিত হলে আসিয়ান ও পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ক্ষতি হবে। ব্যাপারটির অনেক বৃহত্তর কৌশলগত এবং নিরাপত্তাগত পরিণাম রয়েছে।’ সুরিনের শেষ কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যকার ধর্মীয় সংঘাত নয়, এটা নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিষয়। আমাদের খুবই হুঁশিয়ার থাকতে হবে।’ (৩০ অক্টোবর, জাকার্তা পোস্ট)
দেশের ভেতরে যা সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সমস্যা, আন্তর্জাতিক স্তরে তা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত হুমকি। মিয়ানমার যে রূপান্তর পর্ব পার করছে, তা এই অঞ্চলের গণতন্ত্রায়ণ থমকে দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক সংঘাত ছড়িয়ে দিতে পারে। দেশটিতে বর্মি প্রাধান্যের বিরুদ্ধে কারেন, কাচিং, মং, চীন, রাখাইনসহ অজস্র জাতিগোষ্ঠীর দীর্ঘ সশস্ত্র লড়াই চলছে। সরকারিভাবে ১৩৫টি স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বর্মিরা একাই ৫০ শতাংশ। অথচ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সম্পদের ৮০-৯০ ভাগের মালিক তারা। এই জাতীয়তাবাদের প্রধান হাতিয়ার হলো থেরাভাদা বৌদ্ধবাদ। দেশটির খ্রিষ্টান, মুসলিম, প্রাণীপূজক ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের অসীম বিদ্বেষ। সু চি নিজেও থেরাভাদা বৌদ্ধবাদী বর্মি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত বই বার্মা অ্যান্ড ইন্ডিয়ায় তিনি লিখেছেন, ‘বৌদ্ধবাদ হলো শ্রেষ্ঠ দর্শন…সুতরাং এর কোনো সংস্কার যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি দরকার নেই অন্য কোনো দর্শনকে বিবেচনায় আনা।’ এককথায়, এটাই মিয়ানমারের অধিপতি বর্মি শাসকদের রাজনৈদিক মতাদর্শ। অধিকাংশ বর্মি এর অনুসারী।
২০০৭ সালের গেরুয়া বিপ্লবে সু চির পক্ষে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বিপুলভাবে রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। গণতন্ত্রপন্থী সেই ধর্মীয় বিক্ষোভ থেকেই সন্ন্যাসীরা বর্মিদের আপন ও শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠেন। তাঁরা হয়ে ওঠেন একই সঙ্গে সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা। সু চির বর্তমান জনপ্রিয়তা ও জনভিত্তির খুঁটিও এই সন্ন্যাসীরা। চার মাস ধরে চলা রোহিঙ্গা নির্মূলকরণ অভিযানের নায়কেরাও মোটামুটি সু চি-সমর্থক গণতন্ত্রপন্থী। অথচ ১৯৯০ সালের নির্বাচনেও চারজন রোহিঙ্গা সে দেশের এমপি হয়েছিলেন।
গত জুলাইয়ে সিত্তে শহরে দাঙ্গার শুরু করেছিলেন সু চির দলের এক এমপি। এবারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন গেরুয়া বিপ্লবের নেতারা। এঁদের অন্যতম হলেন সন্ন্যাসী বিরাথু। ২০০৩ সালে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা উসকানোর অভিযোগে ২৫ বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর। পরে রাজনৈতিক বন্দীদের মুত্তির প্রক্রিয়ায় তিনিও ছাড়া পান। তিনি এখন যুব সন্ন্যাসী সমিতির প্রধান। এই সংগঠন অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে একযোগে রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারাভিযান চালাচ্ছে, বাধা দিচ্ছে উদ্বাস্তুদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর কাজে। আরেক সন্ন্যাসী নেতা আসিন হতাওয়ারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠাতে বদ্ধপরিকর। সু চি তাঁর ‘বিশেষ প্রিয় নেতা’। তিনি চান, রোহিঙ্গাদের নাৎসি জার্মানির ইহুদিদের মতো করে শ্রমশিবিরে রাখা হোক। উগ্র বৌদ্ধপন্থী বর্মি জাতীয়তাবাদ নিজেদের হিটলারি জার্মানির আর্যগর্বের মতো বিশুদ্ধ বর্মি জাতির স্বপ্ন দেখায়, যেখানে অবর্মি ও অবৌদ্ধরা হবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এই জাতীয়তাবাদীরা এর আগে মিয়ানমারের চীনা বৌদ্ধদের ওপর বিরাট গণহত্যা চালিয়েছিল। ভোট হারানোর ভয়ে
সু চিও নীরব। সু চি ও সামরিক জান্তা উভয়ই জাতিগত বিদ্রোহ থেকে দৃষ্টি সরানোয় রোহিঙ্গা কার্ড খেলে চলেছেন। রাখাইন প্রদেশের আরাকান লিবারেশন আর্মিও মনে করে, বর্মিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আগে রোহিঙ্গা বিতাড়নে সরকারকে সহযোগিতা দেওয়া লাভজনক।
মিয়ানমারের নব্য জাগরিত পুরোহিততন্ত্র পাশে পাচ্ছে রাষ্ট্রপ্রশাসন, গণমাধ্যম এবং ব্যবসায়ী শ্রেণীকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তহবিলপুষ্ট ন্যাশনাল এনডৌমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি এবং কুখ্যাত মার্কিন ধনকুবের জর্জ সরোসের ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটিউট এদের প্রধান আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক। এরাই মিয়ানমারের ভেতরে ও বাইরে গণতন্ত্রপন্থীদের প্রশিক্ষণ ও তহবিল দিয়ে আসছে। ব্রিটেনের বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকেও একইভাবে সু চির অনুসারীদের শক্তিশালী করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব ইস্ট এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের প্রতিবেদন খোলাখুলি জানাচ্ছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের জন্য কাজ করে যাওয়ায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক কর্মীদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাবে।’
সুতরাং বর্মি ও রাখাইন উগ্র সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ আর গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের প্রতিশোধস্পৃহার ক্রসফায়ারে বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি যাওয়ার হুমকিতে।
দুই.
বুঝতে অসুবিধা হয় না, শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী সু চি সামরিক জান্তার সরকারের সঙ্গে কেনই বা সহযোগিতা করছেন আর কেনই বা মিয়ানমারের অঢেল খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার বিনিয়োগের পক্ষে ওকালতিতে নেমেছেন। গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী একই সঙ্গে মিয়ানমার থেকে চীনের প্রভাব ও বিনিয়োগ দুই-ই কমিয়ে ফেলতে চান। খেয়াল করার বিষয়, মিয়ানমারের যে দুটি প্রদেশে এখন জাতিগত সহিংসতা চলছে, দুটিতেই চীনের বিরাট বিনিয়োগ রয়েছে। একটি হচ্ছে, কারেন প্রদেশ, সেখানে চীনা বিনিয়োগে নির্মিত বিরাট এক পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এই প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুৎ চীনের কিছু অঞ্চলের জ্বালানি ঘাটতি মেটানোয় অপরিহার্য ছিল। রাখাইন প্রদেশের প্রলম্বিত অশান্তিতে এসবই ভেস্তে যাওয়ার মুখে।
রাখাইন প্রদেশসংলগ্ন বঙ্গোপসাগর এলাকা কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ। চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত। এই রাখাইন উপকূল থেকেই গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের ইউনান প্রদেশে যাওয়ার কথা। চীনের জন্য বঙ্গোপসাগরে বের হওয়ার কৌশলগত পথও এটি। রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিত্তে শহরে চীনা তহবিলে বন্দর নির্মাণও চলছে। সম্প্রতি ধ্বংস হওয়া রোহিঙ্গা বসতিও এর কাছেই ছিল। এর উল্টো দিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা প্রসারিত হওয়াজনিত জটিলতাও এই পটভূমির অংশ।
সুতরাং, রাখাইন প্রদেশ থেকে রামু পর্যন্ত জাতিগত দ্বন্দ্ব উসকে ওঠাকে কেবল সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সমস্যা হিসেবে ভাবার সুযোগ নেই। আসিয়ান-প্রধানও সেই ইঙ্গিতই করেছেন। বিশ্বের দিকে তাকালেও দেখা যায়, জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল অথবা তেল-গ্যাসের আন্তর্জাতিক পাইপলাইনের আশপাশজুড়েই অন্তহীন সহিংসতা চালু আছে। চালু আছে যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, সামাজিক অসন্তোষ এবং ন্যাটোর সামরিকায়ন। পশ্চিমা সরকার, মানবাধিকার সংস্থা, এনজিওগুলো সেই অঞ্চলেই গণতন্ত্র রপ্তানির জন্য ব্যতিব্যস্ত, যেখানে তাদের মালিকানার দানবীয় জ্বালানি কোম্পানিগুলো খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ পেতে মরিয়া। জাতি-সম্প্রদায়-পরিবার ও দেশ তাদের চোখে দাবার ঘুঁটি মাত্র। রোহিঙ্গা বনাম রাখাইন দ্বন্দ্বে তাই বাংলাদেশকে যেমন মানবিক হতে হবে, তেমনি হতে হবে দীর্ঘমেয়াদিভাবে কৌশলী।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]
Leave a Reply