টেকনাফ নিউজ ডেস্ক : প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গত সপ্তাহে নতুন করে সামপ্রদায়িক সংঘাত শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ইস্যুতে অবস্থান বদলায়নি ঢাকা। মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা কক্সবাজারের রামুতে গত মাসের শেষ দিকে বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের ওপর হামলার পর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ইস্যুটির স্পর্শকাতরতা আরো বেড়েছে। তাই বিষয়টিকে অত্যন্ত কড়া নজরে রেখেছে সরকার। এদিকে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় গত চার দিনে ৫১ রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী নেওয়ার মতো অবস্থা বাংলাদেশের নেই। তা ছাড়া গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রামুতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সেখানে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কাজ করছে। নতুন করে শরণার্থী নিলে ওই প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, রামুতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের ওপর হামলায় রোহিঙ্গাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল_বিভিন্ন মহল থেকে এমন অভিযোগ উঠেছে। রোহিঙ্গারা মুসলমান, অন্যদিকে রাখাইনরা বৌদ্ধ। মিয়ানমারে বৌদ্ধদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে_এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
উল্লেখ্য, এর আগে গত মে মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামপ্রদায়িক সংঘাতের পর আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলো আহ্বান জানায়। তবে বাংলাদেশ এ বিষয়ে অপারগতার কথা জানিয়ে নিজ অবস্থানে অনড় থেকেছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি বরাবরই মানবিক আচরণ করেছে। সীমান্তে গুলিবর্ষণ বা দমন-পীড়ন তো চালানো হয়ইনি, বরং আশ্রয় দেওয়া হবে না জেনেও মিয়ানমার থেকে যারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে সরকার।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছে। এ ছাড়া আরো তিন থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে অবস্থান করছে। তাদের কারণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার জীবন-জীবিকা ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও বাংলাদেশের আচরণ নিবর্তনমূলক নয়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটিও বেশ জটিল। মিয়ানমার বিভিন্ন সময় নাগরিকত্ব যাচাই করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও গত কয়েক বছরে তা বাস্তবায়ন করেনি। বর্তমানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ যেখানে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে সেখানে নতুন করে রোহিঙ্গা প্রবেশের সুযোগ দিলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। এ কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলে ভবিষ্যতে তাদের স্থায়ীভাবে রাখার জন্য বাংলাদেশের ওপরই চাপ বাড়তে পারে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সম্ভাব্য ঢাকা সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুর জটিলতা কাটবে বলে বাংলাদেশ আশা করছিল। কিন্তু ওই সফর কবে নাগাদ হবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
৫১ রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত
কক্সবাজার অফিস ও টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে নতুন করে শুরু হওয়া জাতিগত দাঙ্গার সূত্র ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার সীমান্ত এলাকায় বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে টেকনাফের নাফ নদী থেকে সেন্টমার্টিন সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত বিজিবির পাশাপাশি কোস্টগার্ডের পাহারাও বাড়ানো হয়েছে। আরাকানের রোহিঙ্গারা যাতে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে জন্যই বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়।
ঈদুল আজহার চার দিন আগে আরাকানের আকিয়াবে দ্বিতীয় দফায় নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়। পরে তা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় রোহিঙ্গাদের শত শত বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। হামলার শিকার হয়ে ছোট-বড় ইঞ্জিন নৌকায় করে বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে জন্য কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, পুলিশ-বিজিবি ও কোস্টগার্ড সীমান্ত এলাকায় সর্বোচ্চ নজরদারিতে রয়েছে। তবে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করা হলেও তা ঘটেনি বলে নিশ্চিত করেছেন বিজিবি ও কোস্টগার্ড কর্মকর্তারা। সর্বশেষ গতকাল সোমবার উখিয়ার বালুখালী সীমান্তে সাতজন এবং পালংখালী সীমান্তে ৯ জনসহ ১৬ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকালে বিজিবি সদস্যরা আটক করেন। পরে তাদের চিকিৎসাসেবা ও খাবার দিয়ে স্বদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে গত চার দিনে সীমান্তে ৫১ জন রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশকালে আটক করে স্বদেশে পাঠানো হলো।
কক্সবাজারের ১৭ বিজিবি ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মো. খালেকুজ্জামান জানিয়েছেন, চলতি মাসে এ পর্যন্ত ২৩২ জন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাকে আটকের পর স্বদেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
Leave a Reply