ডা. জুলহাস উদ্দিন
চোখের ড্রপ, ইনসুলিন বা ইনহেলার নিয়ে অনেকে অস্বস্তিতে থাকেন রোজার মাসে। বুঝে উঠতে পারেন না কিভাবে ব্যবহার করলে রোজার ক্ষতি হবে না। এই সময়ে ডায়াবেটিস, অ্যাজমা বা রক্তচাপের সঙ্গে লড়বেন কিভাবে, পরামর্শ দিচ্ছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ এবং সাহাব উদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. জুলহাস উদ্দিন। লিখেছেন ডা. দিবাকর সরকার
খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু শরীর অনশন অবস্থায় (ফাস্টিং স্টেট) যায় না। সর্বশেষ খাবার গ্রহণের মোটামুটি আট ঘণ্টা পর ফাস্টিং স্টেট শুরু হয়। অর্থাৎ খাবার গ্রহণের আট ঘণ্টা পর্যন্ত ওই খাবার শরীরে হজম হয়, তা থেকে শক্তি সরবরাহ হতে থাকে। আট ঘণ্টা পর ওই খাবারের সরাসরি প্রভাব শরীরে আর থাকে না। সেহরির খাবারের গ্লুকোজ যখন আট ঘণ্টা পর শেষ হয়, তখন শরীরে সঞ্চিত চর্বি ভেঙে শক্তি তৈরি হয়। এ কারণেই রোজায় শরীরের ওজন খানিকটা কমে। তবে মাংসপেশির প্রোটিন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। শরীরের বাড়তি এই চর্বি কমে যাওয়ার ফলে কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। একই সঙ্গে শরীরে ডিটক্সিফিকেশন ঘটে। অর্থাৎ শরীরে জমে থাকা কিছু ক্ষতিকর পদার্থ- প্রস্রাব, পায়খানা, ঘাম ইত্যাদি বডি ফ্লুইডের সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
কয়েক দিন রোজা পালনের পর রক্তে এনডোরফিনসের মতো কয়েকটি হরমোনের মাত্রা বাড়ে। এই হরমোনটি মানুষকে বেশি সচেতন করে, শরীর ও মনকে প্রফুল্ল রাখে।
ডায়াবেটিক রোগী
রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে থেকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে সহজ ও নিরাপদ উপায়ে রোজা পালন করা যায়। যেসব রোগী শুধু ব্যায়াম ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যাঁরা সেনসিটাইজার-জাতীয় ওষুধ (মেটাফরমিন ও গ্লিটাজন) ব্যবহার করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রা কম। অন্যদিকে সালফোনাইল ইউরিয়া ও ইনসুলিন ব্যবহারকারীরা জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া : এ জাতীয় ডায়াবেটিসের লক্ষণ হলো অস্থির বোধ করা, অতিরিক্ত ঘাম, বুক ধড়ফড় করা, চোখে ঝাপসা দেখা, অত্যধিক ক্ষুধা, অস্বাভাবিক আচরণ ইত্যাদি। যদি রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ তিন দশমিক পাঁচ মিলিমোল/লিটারের নিচে কমে যায়, তবে তাৎক্ষণিকভাবে রোজা ভেঙে না ফেললে বিপদ হতে পারে। এক গ্লাস পানিতে চার থেকে ছয় চামচ চিনি গুলিয়ে খাওয়ানো উত্তম। অজ্ঞান রোগীর ক্ষেত্রে মুখে খাবার না দিয়ে চিকিৎসাকেন্দ্রের সহায়তায় শিরায় গ্লুকোজ প্রয়োগ করা জরুরি।
হাইপারগ্লাইসেমিয়া : এর লক্ষণগুলো হলো বমিভাব, মাথা ঘোরা, পানির পিপাসা, দুর্বলতা ইত্যাদি। এ অবস্থায় রক্তে কিটোনবডির মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে কিটোএসিডোসিসের মতো জীবন সংশয়কারী অবস্থা তৈরি হয়। কাজেই লক্ষণগুলো প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্লুকোমিটার ও রক্ত পরীক্ষা, ইনসুলিন গ্রহণ এবং দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
রোজার পূর্ব প্রস্তুতি : রমজান শুরু হওয়ার আগে খাদ্য ও তরল খাবার সম্পর্কে ডাক্তারের কাছ থেকে চার্ট করে নিন। মুখে গ্রহণের ওষুধের ধরন ও মাত্রা পরিবর্তন করতে হবে কি না তা জেনে নিন। সাধারণত সকালের ডোজ সামান্য কম মাত্রায় ইফতারের সময় এবং
* রাতের ডোজ অর্ধেক মাত্রায় সেহরির সময় খেতে বলা হয়।
* ইনসুলিনের ক্ষেত্রে সকালের ডোজ ইফতারের সময় এবং রাতের ডোজ কিছুটা কম পরিমাণে সেহরির সময় নিতে হয়।
* সম্ভব হলে আধুনিক, দীর্ঘস্থায়ী ইনসুলিন (গ্লারজিন ও ডেটেমির) এবং যেসব মুখে খাওয়ার ওষুধ রমজানে বিশেষ উপযোগী (গ্লিক্লাজাইড এমআর, গ্লিমেপেরাইড) সেগুলো ব্যবহার করা দরকার।
* দিনের বেলায় ব্যায়াম পরিত্যাগ করে ইফতার অথবা রাতের খাবারের পর আধা ঘণ্টা ব্যায়াম করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, তারাবির নামাজে পর্যাপ্ত ব্যায়াম হয়ে থাকে।
* রোজা পালনরত অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজ মাপা ও চামড়ার নিচে ইনসুলিন গ্রহণ করা জায়েজ বলে দেশের ও মুসলিম বিশ্বের আলেমরা মত দিয়েছেন।
* সেহরির দুই ঘণ্টা পর এবং ইফতারের এক ঘণ্টা আগে গ্লুকোজ পরীক্ষা করে ওষুধের মাত্রা ঠিক করতে হবে।
রক্তচাপের রোগী
যেসব রোগী অল্প মাত্রা অথবা মধ্যমাত্রায় রক্তচাপে ভুগছেন তাঁদের জন্য রমজান এক বিশেষ সময়, যার মাধ্যমে রোগী রক্তচাপ কমাতে পারেন। কারণ এ সময় ক্যাটকোলামিন কম নিঃসরণ হয়, ফলে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া এসময় মন প্রশান্ত থাকে। সাধারণত কোনো ধরনের যান্ত্রিক জীবন পালন করা হয় না। এটাও আমাদের রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। কারণ অতিরিক্ত চিন্তা ও যান্ত্রিক জীবন রক্তচাপের এক প্রধান কারণ। রোজার মাসে আমরা সাধারণত দুইবার ঘুমাতে যাই ও দিনে দুইবার নির্ঘুম অবস্থায় থাকি। ফলে আমাদের রক্তে কার্টিসলের পরিবর্তন আসে, যা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। তবুও যেকোনো রক্তচাপের রোগীদের উচিত ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে রমজান পালন করা।
অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের রোগী
রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকলে অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের রোজা রাখতে কোনো বাধা নেই। ইনহেলার নিলে রোজা নষ্ট হবে কি না চিকিৎসক হিসেবে তা বলা মুশকিল। কেননা সঠিক নিয়মে ইনহেলার নিলে রক্তে ওষুধ মিশতে পারে না বা নগণ্য পরিমাণ মিশতে পারে। তাই সেহরি ও ইফতারের সময় ইনহেলার নিন। আর হঠাৎ তীব্র শ্বাসকষ্ট হলে দেরি না করে রোগীকে হাসপাতালে নিন।
পেপটিক আলসার বা এসিডিটি
পেপটিক আলসারের রোগীদের প্রধান কাজ হলো নিয়মিত খাবার খাওয়া, নিয়মিত ঘুমানো এবং নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ। রোজায় মানুষের জীবন একটা নিয়মে চলে আসে বলে এ সময় এসিডিটির সমস্যা অনেকখানি কমে যায়। কেউ যদি ভয় পেয়ে যান এই ভেবে যে রোজায় তাঁর এসিডিটির সমস্যা বেড়ে যেতে পারে, তাহলে তিনি সেহরি ও ইফতারের সময় রেনিটিডিন বা ওমিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধ একটা করে খেয়ে নিতে পারেন। পাশাপাশি অবশ্যই ভাজাপোড়াজাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। তবে যাঁদের দীর্ঘমেয়াদি পেপটিক আলসার বা পেটে ঘা রয়েছে, তাঁদের রমজানে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে :
* রক্ত বমি অথবা কফি রঙের বা কালচে রঙের মতো বমি হলে।
* পেটে তীব্র ব্যথা অনুভূত হলে। পেটের আলসারের ব্যথার সঙ্গে পেছনে পিঠের দিকে তীব্র ব্যথা শুরু হলে। অনেক সময় আলসারের কারণে পাকস্থলী অথবা অন্ত্র ছিদ্র হয়ে গেলে এমন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
* দুর্বল, অবসাদ অথবা দেহ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে। কোনো কোনো সময় আলসারের কারণে পেটের মধ্যে অনেক রক্ত ক্ষরণ হলে এ ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
* কালো অথবা রক্ত মিশ্রিত পায়খানা হলে।
চোখের রোগী
রোজায় চোখের রোগীরা যে সমস্যায় পড়েন সেটি হলো রোজা রাখা অবস্থায় ড্রপ ব্যবহার করতে পারবেন কি না। এর কারণ চোখে ড্রপ দিলে তা মুখে চলে যেতে পারে, যা রোজার জন্য ক্ষতিকর। বিষয়টি চোখের সঙ্গে নাকের যোগাযোগকারী একটি নালি আছে। কেউ কাঁদলে চোখের পানি নাকে চলে আসে। তাই চোখে ড্রপ দেওয়ার সময় চোখের ভেতরের কোনায় (নাকের পাশে) চেপে ধরলে নালিটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ওষুধ নাকে বা গলায় যাওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না। সে ক্ষেত্রে রোজা রেখে আপনি অনায়াসে চোখে ড্রপ দিতে পারেন। প্রয়োজনে পদ্ধতিটি রপ্ত করার জন্য আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
গর্ভাবস্থায় এবং দুধদানকারী মা
সেহরি ও ইফতারে উপযুক্ত পরিমাণে সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে সারাদিনের পুষ্টি স্বাভাবিক সময়ের মতোই পূরণ করা সম্ভব। তবে গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস ও শেষ তিন মাস রোজা না রাখাই ভালো। তবে এ ক্ষেত্রে ডাক্তার যদি পরামর্শ দেন এবং নিজের শরীর যদি সুস্থ থাকে, তাহলে গর্ভবতী অবস্থায় রোজা রাখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। বেশি ভাজাপোড়া ও অতিরিক্ত চিনি-সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। ভাজাপোড়া, বদহজম, বুক জ্বালাপোড়াসহ দেহের ওজন বাড়িয়ে দেয়। আর চিনি-সমৃদ্ধ খাবারে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ এড়িয়ে চলতে হবে। অতিরিক্ত চা ও কফি পান করা উচিত নয়; এগুলো অতিরিক্ত প্রস্রাব তৈরির মাধ্যমে দেহে পানিস্বল্পতার সৃষ্টি করে, ফলে দেহ দুর্বল হয় পড়তে পারে।
যেসব মা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ান তারাও রোজা রাখতে পারেন। কারণ সমীক্ষায় দেখা গেছে, রোজা রাখলে দুধের উৎপাদনে ও গুণগত মানে কোনো পরিবর্তন আসে না। তবে এ ক্ষেত্রে মায়েদের পানি ও তরল খাবারের দিকে একটু বেশি নজর দিতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে যদি শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকে তবে রোজা রাখা যেতে পারে।
কিডনি রোগী
কিডনি রোগ হলেই রোজা রাখা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কিডনি ফেইলিউর রোগীদের সুনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হয়, নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, এমনকি পানি খাওয়ার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা হয়। তাই রোজা রাখার ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। আশার কথা হলোথইরান, লিবিয়া ও সৌদি আরবে কিডনি রোগীদের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অল্প থেকে মধ্যম মাত্রার কিডনি ফেইলিউর রোগীরা রোজা রাখলে কোনো ক্ষতি হয় না। সামান্য যা হয়, রোজার মাস শেষ হয়ে গেলে ১৫ দিনের মধ্যেই তা আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে যাঁদের কিডনি ফেইলিউরের মাত্রা একেবারে শেষ পর্যায়ে, তাঁদের পক্ষে রোজা রাখা সম্ভব নয়। তেমনি যাঁরা ডায়ালাইসিসের রোগী অথবা ইতিমধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন, ঘড়ির কাঁটা দেখে ওষুধ খেতে হয় বলে তাঁদের পক্ষেও রোজা রাখা প্রায় অসম্ভব। তবে শারীরিক অবস্থা যা-ই থাকুক না কেন, সর্বাবস্থায় আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়াই শ্রেয়।
Leave a Reply