কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া থেকে : প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত ও চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মিয়ানমার সফরকালে প্রায় এক ডজন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। দেশটিতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসায় বিদেশি বিনিয়োগ ও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। অথচ মিয়ানমারে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের দিকে যথাযথ নজর না দেওয়ায় এসব সম্ভাবনা থেকে বাংলাদেশ ক্রমেই ছিটকে পড়ছে বলে জানিয়েছেন অভিজ্ঞজনরা। সচেতন মহল জানিয়েছে, ভারতসহ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাপক গুরুত্ব দিলেও প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সেভাবে নজর দেওয়া হয়নি।
মিয়ানমারে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে তেমন দক্ষতা দেখাতে পারেননি। দেশের শীর্ষ পর্যায়ে থেকেও বিষয়টিকে আমলে নেওয়া হয়নি। তাই দুই দেশের মধ্যে কয়েকবার ভিভিআইপি সফর হলেও তার ফলোআপ করা হয়নি। এসব সফরের সময় যেসব চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, সেগুলো নিয়েও সামনে এগোনোর জোর চেষ্টা চালানো হয়নি। বলতে গেলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কোন্নয়নে দায়সারা গোছের কাজ করা গেছে বাংলাদেশ মিশন। মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানির লক্ষ্যে গত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করা হলেও কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। অথচ চীন ও ভারত মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানি করছে। মিয়ানমারে লাখ লাখ একর অনাবাদি জমি পড়ে আছে। এসব জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে বাংলাদেশের খাদ্য ঘাটতি মেটানোর আগ্রহ দেখালেও সে ক্ষেত্রেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশও মিয়ানমারের মধ্যে সংযোগ সড়ক নির্মাণের লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হলে যথাযথ উদ্যোগের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের কথা থাকলেও তা হয়নি। মিয়ানমারে সার উৎপাদন করে বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর কথা থাকলেও সে বিষয়ে কোনো সুফল আসেনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। প্রতিবেশী প্রায় সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বিমান চলাচল করলেও মিয়ানমারের সঙ্গে এখনও সরাসরি কোনো ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। দুই দেশের মধ্যে উন্নয়নে মিয়ানমারের বাংলাদেশ মিশন কোনো উদ্যোগই হয়নি। ফলে ব্যাপক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাকে কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে আমদানির পরিমাণই বেশি। মিয়ানমার থেকে সাধারণত চাল, ডাল, মাছ, মশলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসই বেশি আমদানি করা হয়।
সিডরের পর মিয়ানমার থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করে বাংলাদেশ। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে প্রতিবছর ১ লাখ টন চাল আমদানি করার প্রস্তাবটিও প্রক্রিয়াধীন। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিমাণ ওষুধ, সিরামিকস, কেমিক্যাল, পোশাক ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী মিয়ানমারে রপ্তানি করা হয়।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিশাল প্রতিনিধিদল নিয়ে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন মিয়ানমারের সিনিয়র ভাইস জেনারেল মং আই। সফরকালে তিনি বলেছিলেন, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্যের পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। কিন্তু এ বিষয়ে মিয়ানমারে বাংলাদেশ মিশন থেকে যথাযথ ফলোআপ না করায় বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তবে এর বাইরে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে চীনের ওপর ভরসা করে এসেছে বাংলাদেশ। কিন্তু চীন বারবার বলে এসেছে, বাংলাদেশের কোনো ব্যাপারে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া সম্ভব নয়। যা কিছু করার মিয়ানমারের সঙ্গে বসেই নির্ধারণ করতে হবে বাংলাদেশকে। সম্প্রতি মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের অবসান হওয়ায় এবং দেশটিতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসায় বাংলাদেশের জন্য আরও একবার সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
Leave a Reply