তারেক মাহমুদ /ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথমে ব্যাট করলে যে কী হবে…! বিসিবির মাঠসংশ্লিষ্ট একজন কথাটা বলতে বলতে শূন্য দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলেন উইকেটের দিকে। যেন দেখতে পাচ্ছেন শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের বুকে ক্রিস গেইলের তাণ্ডব। শিবনারায়ণ চন্দরপলের উইকেটের জন্য মাথার চুল ছিঁড়ছেন বাংলাদেশের বোলাররা।
টেস্ট শুরুর এক দিন আগেই অমন হূদয়বিদারক কল্পনায় কেন আঁতকে উঠলেন ভদ্রলোক? ওয়েস্ট ইন্ডিজ আগে ব্যাট করলেও বাংলাদেশের বোলাররা আছেন না! থাকলেই কী? সেই বোলারদের একজনই তো কাল অনুশীলন শেষে প্রায় আত্মসমর্পণ করে এসেছেন মাঠের মাঝখানে গিয়ে। উইকেটের ওপর সকালে দেখা সবুজের আভাটা নেই। খটখটে ন্যাড়া ২২ গজ তাঁকে চিন্তায় ডুবিয়ে দিল, ‘উইকেটে তো কিছুই নেই!’ বলাই বাহুল্য, বোলারটি একজন পেসার।
টেস্ট ক্রিকেটটা এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য বার্ষিক পরীক্ষার মতো। বছরে একবার হয়। সেই একবারের জন্য প্রস্তুতি হয় পরীক্ষার আগে আগে। এবার যেমন জাতীয় লিগে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলে খেলোয়াড়দের নামতে হচ্ছে এক বছর আগের অভ্যাস পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জে। সঙ্গে আছে গেইলের চোখ রাঙানি। বাংলাদেশ দল এত ঝামেলার মধ্যে বেস্ট-এডওয়ার্ডসদের বলের ধার বাড়ানোর ঝুঁকি কেন নিতে চাইবে? কিউরেটর উইকেটে বেশ ঘাস রাখলেও সেটিকে তাই ছাঁটতে বলা হলো। দুই দফায় তা করার পর মিরপুরের উইকেটের চেহারা এখন পুরোপুরি মুণ্ডিত মস্তকের মতো। সেটা দেখেই ওই পেসারের অমন আক্ষেপ, গেইলকে নিয়ে মাঠসংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।
এক বছর পর টেস্ট খেলতে নামা বাংলাদেশ দলের গেমপ্ল্যানের অনেকটা জুড়েই ‘গেইল ঠেকাও’ প্রকল্প। আর তাতে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পাওয়া সোহাগ গাজীর অভিষেক হয়ে যাচ্ছে আজ শুরু প্রথম টেস্টে। শুধু গেইলের জন্য অবশ্য নয়, ক্যারিবীয় ব্যাটিং-অর্ডারে বাঁহাতির প্রাচুর্যের কারণে অনেক আগে থেকেই দলে একজন অফ স্পিনারের প্রয়োজন অনুভব করছিল বাংলাদেশ দল। ব্যাটসম্যান-অফ স্পিনার সোহাগ প্রথম সুযোগেই অভিষিক্ত হয়ে যাচ্ছেন সে কারণে। তাঁকে জায়গা দিতে একাদশের বাইরে থাকবেন বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ ইলিয়াস। কাল রাতের টিম মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা টেস্টের দলে থাকবেন না নাজিমউদ্দিন, আবুল হাসানও। তবে দুপুরের সংবাদ সম্মেলনে মুশফিক বলে গিয়েছিলেন, দল হবে আজ সকালে উইকেট দেখে। উইকেট হালকা ঘাস থাকলে তিন পেসার নিয়ে খেলতে পারেন। নয়তো ঝুঁকতে পারেন নিজেদের শক্তির জায়গা স্পিনেও। বিকেলের মধ্যে উইকেটের চেহারা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায়ই বোধ হয় একাদশ ঠিক করার জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো না।
শেষ পর্যন্ত এই টেস্টের জন্য মিরপুরের উইকেটের যে চূড়ান্ত যে চেহারাটা দাঁড়িয়েছে, ড্যারেন স্যামি মনে মনে সেটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সংবাদ সম্মেলনেও বলতে দ্বিধা করলেন না, ‘ঢাকায় আগে যে রকম উইকেট দেখেছি, তার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু দেখলেই বরং অবাক হব।’ তবে মিরপুরের আউটফিল্ড যে নতুন লাগছে, আগের মতো সেটা কালও বলেছেন। এমনকি বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমও বলতে বাধ্য হলেন, ‘কয়েক মাস আগেও মাঠ যেমন ছিল, এখন আর তেমন নেই।’ পরিবর্তনটা শুধু বাজে ঘাসে ভরা অসমতল উপরিভাগে নয়, সাম্প্রতিক মাঠ সংস্কারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মাটির নিচে থাকা পানিনিষ্কাশনব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়েছে অনেকাংশে। শীতের আগমনী হাওয়ায় ভেসে যদি হঠাৎ বৃষ্টি আতিথেয়তা নিতে চায় এই সিরিজে, অতিথিসেবায় ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারেন শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের শ্রীলঙ্কান কিউরেটর গামিনি ডি সিলভা।
মাঠ, বৃষ্টি আর গেইলদের বাইরে এই সিরিজে তেমন দুশ্চিন্তা নেই বাংলাদেশ দলের। বাকিটা কেবলই সুখময় কল্পনা। এই সিরিজেই মোহাম্মদ রফিকের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে টেস্টে শততম উইকেট পেয়ে যেতে পারেন সাকিব আল হাসান। অপেক্ষা মাত্র চারটি উইকেটের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বশেষ হোম সিরিজে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে পাওয়া জয় দলের আত্মবিশ্বাসেও দিচ্ছে ফুরফুরে হাওয়া। তবে টেস্টের সাফল্য খুঁজতে আরেকটু পিছিয়ে ২০০৯-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে।
টিম বাসে বা নাশতার টেবিলের আড্ডায় হয়তো মুশফিকরা সেখানেও ঢুঁ মারছেন। কিন্তু স্যামিকে সেই স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিলেই পাল্টা মনে করিয়ে দেন, ‘২০০৯ সালে নিয়মিত অনেক ক্রিকেটারই ছিল না আমাদের।’
কথাটা সত্যি। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০০৯-এর ভাঙা জাহাজ নয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতা ক্যারিবীয় কনকর্ড। ককপিটে যার ক্রিস গেইল নামের এক পাইলট। কানে হেডফোন। চোখটা শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ন্যাড়া উইকেটে।
Leave a Reply