গাজী কাশেম, নিউইয়র্ক থেকে : ৫ জানুয়ারি, ২০১২। রাত ৮টা। কনকনে শীত, হাড্ডিতে গিয়ে লাগছে। হুমায়ূন আহমেদ বেলভ্যু হাসপাতালে। দেহে কেমোথেরাপি চলছে। চলবে প্রায় তিন-দিবস দুই-রজনী। ফোন পেলাম তিনি বেদানা খাবেন। তখন বেদানার আকাল। বেশ কয়টা দোকানে গেলাম। পরে একটা দোকানে চিড় ধরা শুকনো এবং নিংড়ানো দুটো পেলাম। ঘর থেকে তাঁর নৈশভোজ নিয়ে শিগগিরই হাসপাতালে পৌঁছতে হবে, তাঁর বেশ ক্ষিধে পেয়েছে।স্বর্ণা, মাজহারের স্ত্রী, খাবারগুলো প্রস্তুত করে রেখেছে। বাসা থেকে হাসপাতাল ২৪ মাইল দূরে। আজ আর কৃপণতা করলাম না, ইস্ট রিভার নদীর তলদেশ ভেদ করে যে টানেল ম্যানহাটনকে ছুঁয়েছে সেই টানেলপতিদের ৬ ডলার দিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে পৌঁছে গেলাম হাসপাতালে।
মাজহার আমার পাস নিয়ে নিচে নেমে এলেন, আমি আমার বুকে পাস ধারণ করে একটু শংকিত অবস্থায় পুলিশের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। পাসে লেখা ‘শাওন’ পুলিশ বলল, ওকে, গুড, গো।
১৬ তলার ৩৯ ডব্লিউ-তে কেমো চলছে। কয়েকটি স্যালাইন দেহে ধারণ করে তিনি শুয়ে আছেন। মেশিনে টুকটাক আওয়াজ চলছে। দেহটা খুব কাতর হয়ে পড়েছে।
হাতে আমার কয়েকটি স্থানীয় বাংলা পত্রিকা। প্রথমে হাত বাড়িয়ে তা নিয়ে নিলেন। পত্রিকা বা বই দেখলেই সব কিছুর আগে তা তিনি হস্তগত করবেনই। সারা দিনভর তিনি শাওন এবং মাজহার মিলে দাবা খেলেছেন।
রাত অনেক হয়ে গেছে মাজহারের ৮ বছরের ছোট ছেলে, অমিয়ও সারাদিন হাসপাতালে। ঘরে নিনিতের ১০১ ডিগ্রি জ্বর। নিষাদকে খাওয়ানো যাচ্ছে না। নিষাদ খেলনা না পাওয়া পর্যন্ত খাবে না।
যা-ই হোক আমরা সবাই মিলে রুম গোছগাছ করছি। শাওন প্লেটে খাবার দিলেন। হুমায়ূন আহমেদ হাত তুলে চুপচাপ বসে আছেন। আমি বললাম, স্যার খেয়ে নিন। ভাতে হাত না দিয়ে আমাকে বললেন, একটা জোক শোনো। তিনি বলার শুরু করলেন, এক পাগলকে খাবার দেয়া হয়েছে, সে খাবার খাচ্ছে না, মালিক জিজ্ঞেস করল, কী রে খাবার খাচ্ছস না কেন? পাগল বলল, খাব না। মালিক বলল, কেন? পাগল বলল, খাব না, খেলে হাত ধুবো কোথায়? এ-নিয়ে বেশ হাসলেন। বুঝে ফেললাম, কেন এই জোক।
বাটিতে করে জলদি পানি এনে দিলাম, তিনি নৈশভোজ সেরে নিলেন। এবার বিদায়ের পালা। রাত প্রায় ১১টা। হুমায়ূন আহমেদ স্ট্যান্ডে ঝোলানো তিনটি স্যালাইন এবং মেশিনপত্র ঠেলে বাথরুমে গেলেন, আবার তা ঠেলে ফিরে এলেন। দৃশ্যটি খুবই বেদনাদায়ক ছিল আমার কাছে। নার্স এসে তাগিদ দিতে লাগল রোগী ঘুমাবে।
এবার বিদায়ের পালা। আমি বললাম, স্যার রাতে এখানে কেউ থাকে না?
: থাকে।
: কে থাকে স্যার?
উত্তরে বললেন, আজরাইল। আজরাইল আমার খাটের নিচে হাঁটু গেড়ে থাকে। আমি রাতভর তার সাথে কথা বলি, গল্প করি। তার সাথে দাবা খেলি।
আমরা গুডনাইট বলে ফিরে আসি।
Leave a Reply