ফরিদুল মোস্তফা খান,সকাল গড়িয়ে দুপুর। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর মেঘাচ্ছন্ন আকাশটাকে মনে হলো পুড়ে ছাই হওয়া বৌদ্ধপল্লির বেদনার ছবি। কক্সবাজারের ছোট্ট উপজেলা রামু সদর এখনো অস্বাভাবিক নীরব। শহরের প্রায় মধ্যিখানে শ-তিনেক পরিবার নিয়ে বৌদ্ধপল্লিটি। তার ভেতরে ঢুকলে নৈঃশব্দ্য যেন আরও গাঢ় হয়। সরু গলি দিয়ে মূল বৌদ্ধবিহারের পথে হাতের ডানে নতুন কতগুলো তাঁবু।
গত শনিবার রাতের আক্রমণে যাঁদের ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তাঁদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ওই সব তাঁবুর ব্যবস্থা। শূন্য তাঁবুর ভেতরে হাহাকার। ভাত নেই, পানি নেই, নেই মাথাগুঁজার ঠাঁই। ঘটনার পর থেকে শুধু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আর উৎসুক জনতা গেছেন তাদের দেখতে। কিন্তু সরকারিভাবে আজও উপযুক্ত কোন সহযোগিতা করা হয়নি সেখানে। স্থানীয়ভাবে টুকটাক যে সহযোগিতা করা হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই চোখেমুখে আতংকের ছাপ না কমানো পল্লীর বাসিন্দা বৌদ্ধরা নির্বাক দৃষ্টিতে আসমানের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কোথায় যাবেন তারা? কি হবে আসন্ন পূজায়? বলাবলি এখন তাদের, এমপি-মন্ত্রী, ডিসি-এসপি এবং সাংবাদিক এসে লাভ কি? সবাইতো বড় গলায় শুধু আশার ঝুলি দেখায়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পুলিশ জড়িত কাউকে এখনো আটকতো করতে পারেনি বরং হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দায় এড়িয়ে চলছে। এই অবস্থায় নির্বাক বৌদ্ধপল্লীর বাসিন্দাদের স্মৃতিচারণ এখন ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনা। কারণ ক’দিন আগে তাঁদের চালচুলো, হাঁড়ি-পাতিল সবই গেছে। একটি তাঁবুর মুখে বেদনার্ত বদনে বসে আছেন এক বর্ষীয়ান নারী। শিশুরা খালি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুরুষেরা এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছেন। রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলার চতুর্থ দিনের চিত্র এটি। প্রথম তিনদিনের চিত্র কেমন ছিল তা সহজেই অনুমেয়। রামুর সবচেয়ে বড় সীমা বিহারের ভেতরে ঢুকলে পোড়া গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে কাঠের কাঠামো, একটি জায়গা থেকে তখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। বিহারের একটি বারান্দায় পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি। তাঁর চোখের মণিদুটো সাদা। ভুল ভাঙল যখন একজন এগিয়ে এসে বললেন, চোখের মণিদুটো ছিল অতি মূল্যবান পাথরের। আক্রমণকারীরা আগুন ধরিয়ে দেওয়ার আগে মণিদুটো খুলে নিয়েছে। বিশাল মূর্তিটির পায়ের কাছে লম্বা পাটাতন বরাবর ছোট ছোট আরও প্রায় অর্ধশত মূর্তি। কোনোটি ধাবত, কোনোটি পাথুরে। আগুনে কোনোটি জ্বলে গিয়ে রং হারিয়েছে, কোনোটি কালিলিপ্ত, কোনোটি ফেটে চৌচির। কয়েকটির মাথা পড়ে আছে কোলের কাছে। মূর্তিগুলোর পাশে দেখা গেল পোড়া ও আধাপোড়া ত্রিপিটক, আরও কিছু গ্রন্থ। একই বিহারের আরেক পাশে বিশাল একটি ঘরের দরজা খুলে দিলেন একজন। জুতো খুলে ঢুকলাম সিংহবিহার বুদ্ধমূর্তির ঘরে। ভেতরে এক কনুইয়ে ঠেস দিয়ে আধাশোয়া বুদ্ধমূর্তি: তাঁর চোখদুটিতে বুদ্ধের স্বভাবসুলভ ধৈর্য, কিন্তু নাকের একাংশ ভাঙা। আক্রমণ হয়েছে এখানেও। ভাঙার চেষ্টাও চলছিল, কিন্তু বৌদ্ধমূর্তিটি কঠিন ধাতুতে গড়া। নাক ছাড়া তেমন কিছু ভাঙেনি। সেখানেও ছোট ছোট অনেক মূর্তি ভাঙা। একজন বললেন, অনেক মূর্তি আক্রমণকারীরা নিয়ে গেছে! আরেকজন বললেন, ধাতব দানবাক্সের তালা খোলা হয়েছে ধাতু গলিয়ে। কী উপায়ে সেটা করা হয়েছে, সেটা তাঁর কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। হঠাৎ দরজার কাছ থেকে ভেসে এল নারীকণ্ঠে কান্নার শব্দ। তাকিয়ে দেখি, দরজার বাইরে হাঁটু গেড়ে বসে ভেতরের বৌদ্ধমূর্তির দিকে জোড়াহাত তুলে কাঁদছেন এক নারী: ‘ও ভগবান!’ অগ্নিসংযোগের ব্যাপারে প্রায় সবারই অভিযোগ, আক্রমণকারীরা আগুন লাগানোর আগে ‘গান পাউডার’ ও কেরোসিন ছিটিয়েছিলেন, ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে।
গান পাউডার প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্তি। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি গান পাউডার চেনেন? একজন বললেন, ‘সাদা সাদা পাউডারের মতো’। বারুদ ছিটানো হয়ে থাকতে পারে, কারণ ধাতব যেসব বুদ্ধমূর্তি আগুনে ফেটে গেছে, সেগুলোতে উচ্চমাত্রার তাপ সৃষ্টি হয়েছিল। কথা হলো কয়েকজন ভিক্ষুর সঙ্গেও। তাঁরা বিশেষ কিছু বলছেন না; হতবাক হয়ে গেছেন। মনে পড়ল, ঘটনার পরদিন লাল চিং বৌদ্ধবিহারের ভিক্ষু ওয়েছেকা ছারা মহাথেরো (৮৭) বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা কোনো পাপ করেছিলাম। নইলে এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে হলো কেন?’ একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনিও এ রকম মনে করেন? তিনি দূরে ধ্যানমগ্ন মণিহারা বুদ্ধের দিকে তাকালেন শুধু। কিছু বললেন না। মূল চত্বরের ভস্মস্তূপের পাশে জড়ো হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে কিছু তরুণ-যুবক এগিয়ে এসে কথা শুরু করলেন। বর্ষীয়ান ওই ভিক্ষুর মতো তাঁরা মনে করেন না যে, এই আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞ তাঁদের কোনো অজানা পাপের ফল। ক্ষুব্ধ স্বরে তাঁরা অভিযোগ জানালেন। একের পর এক বলতে লাগলেন উত্তেজনা সৃষ্টিকারীদের নাম। তারপর বললেন, বাইরে উত্তেজনা দেখে বৌদ্ধ তরুণ-যুবকেরা এসে জড়ো হয়েছিলেন সীমা বিহারে, মূর্তি পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু থানার ওসি (এ কে নজিবুল ইসলাম) এসে তাঁদের বলেন, ‘আপনারা বাড়ি চলে যান, কেউ এখানে আক্রমণ করতে আসবে না। যদি আসে আমরা সেটা দেখব।’ তরুণ-যুবকেরা চলে যাওয়ার পর দলে দলে লোক এসে আক্রমণ শুরু করে। তাঁরা বললেন, ‘পুলিশ প্রশাসন চাইলে আক্রমণ অবশ্যই ঠেকাতে পারত, কিন্তু পুলিশ তা চায়নি।’ কয়েকজন মধ্যবয়সী নারী দাঁড়িয়ে আছেন এক পাশে। একজনের চোখে অশ্র“র দাগ। একজন বললেন, ‘আমাদের প্রতিবেশীরা “মুসলিম”। সারা জীবন আমরা পাশাপাশি বসবাস করি। কিন্তু হামলার সময় তারা কেউ আমাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি।’ ৬০ বছরের এক মহিলা বললেন, তিনি জীবনে কখনো কল্পনাও করেননি, তাঁদের সম্প্রদায়ের ওপর এ রকম হামলা হতে পারে। বাকি জীবন এখানে কীভাবে কাটাবেন এটাই এখন তাঁর সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয়। প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, আর কোনো বিপদ নেই। কিন্তু তাঁরা ভরসা পাচ্ছেন না। ঘুরে ঘুরে একের পর এক অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। লক্ষ করা হয়নি, আমার পিছু পিছু আসছিলেন এক মধ্যবয়সী লোক। হঠাৎ তাঁর চোখে চোখ পড়ল, তিনি নিজের পরনের জামাটি দেখিয়ে বললেন, ওই জামাটি তাঁর নিজের নয়। তাঁর নিজের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। পাশে টেনে নিলাম তাঁকে। নাম জিজ্ঞেস করলে নামটি বললেন, সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ জানালেন, নামটি যেন না লিখি, কারণ তিনি ভীত। স্থানীয় একটি ব্যাংকে চাকরি করেন, দুই ছেলে, চার মেয়ে, স্ত্রী ও বাবাকে নিয়ে তাঁর পরিবার। ছেলেরা ঢাকায় পড়াশোনা করেন, বাকিদের নিয়ে তিনি বাস করেন ওই বৌদ্ধপল্লিতেই নিজের বাড়িতে। আধাপাকা বাড়িটিতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটু পরে সেখানে ছুটে এলেন তাঁর এক মেয়ে। তিনি কাকতি-মিনতি করতে লাগলেন, তাঁদের বাড়িটি দেখতে যাওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তার বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। শুধু ইটের কয়েকটি দেয়াল ছাড়া পাঁচ ঘরের বাড়িটির সব কিছু ভস্ম হয়ে গেছে। সিকি মাইল দূরের শ্রীকূল পাড়ায় লালচিং বৌদ্ধবিহারের ভস্মস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ৭৮ বছর বয়সী বঙ্কিম বড়–য়া বর্ণনা করছিলেন সেই রাতের বিভীষিকার কথা। তাঁর মনে রাজ্যের প্রশ্ন: ‘এত মানুষ কোত্থেকে এসেছিল? কারা এসব মানুষ? কেন আমাদের ওপর ওদের এত ক্রোধ? আমরা ওদের কী করেছি?’ বঙ্কিম বড়–য়া ধর্মীয় অনুভূতির ওপর কথিত আঘাতের বিষয়টি ঠিকমতো বুঝতে পারছিলেন না বলে মনে হলো। কিন্তু এটা তিনি ঠিকই বুঝে ফেলেছেন, এই ঘর আর তাঁদের নিরাপদ নিবাস নয়। সরকারের কাছে এখন আপনারা কী চান? এই প্রশ্নের উত্তরে নিরাশ কণ্ঠে আঞ্চলিক ভাষায় যা বললেন, তা এই রকম, ‘সরকারের কাছে আর কী চাইব? এখন তো রাস্তা দেখতে হবে।’ কিসের রাস্তা? কোথায় যাবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা নেই। কিন্তু তিনি ভয় পেয়ে গেছেন; আক্রমণ করা হয়েছে বেছে বেছে বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়গুলোতে, পাশের মুসলমান বাড়ি ও দোকানে একটি ঢিলও পড়েনি। এই কাজ শুধু বাইরের লোকেরা এসে করেনি, কারণ বাইরের লোক জানে না, কোন বাড়িটা বৌদ্ধের কোনটি মুসলমানের। বঙ্কিম বড়–য়ার মনে ভয় ঢুকে গেছে এই কারণে যে, তাঁর প্রতিবেশীদের অনেকেও ছিলেন আক্রমণকারীদের সঙ্গে।
উদ্ঘাটিত হলনা হামলার কারণ ঃ
শনিবার রাতে বৌদ্ধপল্লিতে হামলা-অগ্নিসংযোগের চার দিন পরও জানা গেল না, কে বা কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের সামনেই যে একের পর এক বৌদ্ধমন্দির, বসতবাড়ি ও দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা সবাই বলছেন। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এ দৃশ্য নীরবে দেখেছেন। ঘটনার শিকার বৌদ্ধরা অভিযোগ করেছেন, হামলা প্রতিহত করতে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা ও পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আন্তরিক ছিলেন না। তাঁরা আন্তরিক হলে এ ঘটনা প্রতিহত করা যেত। কেউ কেউ এ জন্য রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সদ্য বিদায়ী (ওসি নজিবুলকে অভিযুক্ত করেন। স্থানীয় লোকজন ও তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গান পাউডার ব্যবহার করে বুদ্ধমূর্তিগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, পেট্রল ছিটিয়ে বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঢিল ছোড়ার জন্য চার কোনা কংক্রিটের ব্লক জোগাড় করা হয়, যেগুলো রামুতে পাওয়া যায় না। ট্রাক-বাস-পিকআপে করে গ্রাম থেকে লোক আনা হয়। আবার পবিত্র কোরআন অবমাননার ছবিসংবলিত ফেস্টুনও তৈরি করা হয়েছে। রাতারাতি এত পরিকল্পিত হামলা কীভাবে ঘটানো হলো, কারা করল, টাকার জোগান দিল কারা, এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি। পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর বলেন, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে, পাওয়া গেলে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ঘটনার বর্ণনা:
সেদিনের ভয়ংকর হামলায় ঘরহারা মানুষ গতকালও খোলা আকাশের নিচেই বসবাস করছিল। রাতে বৃষ্টি হলে তারা আরও বিপাকে পড়ে। এরপর সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁদের থাকার জন্য তাঁবু গেড়ে দেন। হামলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৭০৬ সালে স্থাপিত রামু কেন্দ্রীয় সীমাবিহার। গতকাল সকালে সেখানে যাওয়ার পর সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই বিহারের লোকজন ভিড় করেন। তাঁরা সেদিনের ঘটনার মর্ম¯পর্শী বিবরণ দেন। হামলার সময় দুর্বৃত্তরা বৌদ্ধদের ইতিহাসের সংগ্রহশালাও জ্বালিয়ে দেয়। এতে সেখানকার ক¤িপউটার ও অন্যান্য জিনিসপত্র পুড়ে যায়। এসব দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করতেন ববিতা বড়–য়া। কথা বলতেই চোখের পানি মুছে বললেন, ‘সারা জীবন আমরা দুই হাতে মানুষকে দান করে এসেছি। এখন আগুনে নিঃস্ব হয়ে মানুষের কাছেই হাত পেতেছি। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?’ কারা আগুন দিয়েছিল? প্রশ্ন করতেই পাশে দাঁড়ানো মন্দিরের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বললেন, ‘শুরু করেছে এলাকার ছেলেরা। পরে ওদের সঙ্গে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। ওরা ট্রাকে করে, বাসে করে রামুতে আসে। তারা আমাদের মন্দিরের দানের টাকা ও খাবার পর্যন্ত লুট করেছে।’ সহকারী পরিচালক মন্দিরের পুড়ে যাওয়া বুদ্ধমূর্তিগুলো দেখান। সবচেয়ে বড় মূর্তিটি আট মাসে আগে থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়। আট মণ ওজনের এ মূর্তিটির এক চোখ তুলে নিয়েছে হামলাকারীরা। আগুনে তার পা জ্বলে গেছে। পাশেই শোয়ানো অবস্থায় আরেকটি বড় মূর্তি। ওই মূর্তির নাকও ভেঙে ফেলা হয়েছে। আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পুরো মন্দিরটি। প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু অভিযোগ করেন, আগুন দেওয়ার সময় জারে করে পেট্রল আর ব্যাগে করে গুঁড়াজাতীয় পাউডার আনা হয়। সেই পাউডার ছিটানোর পর এতে আগুন দেওয়া হয়। পাউডারের উচ্চ তাপে পিতলের মূর্তিও গলে যায়। আর জারে করে আনা পেট্রল ছিটিয়ে বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। সীমাবিহারে পোড়া মূর্তির দিকে অশ্র“সিক্ত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনবোধী ভিক্ষু। চার কোনা কংক্রিটের ব্লক হাতে ধরে তিনি বললেন, এসব চৌকোনা ব্লক বড় ধরনের কোনো উন্নয়নকাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এমন ব্লক রামুতে কেউ ব্যবহার করে না। হামলাকারীরা বস্তায় ভরে এসব ব্লক কোত্থেকে আনল, তা কেউ বলতে পারছে না। এই ব্লকগুলো বৌদ্ধদের বাড়িঘরে নিক্ষেপ করা হয়। রামুর শ্রীকুলে পাশাপাশি দুটি বৌদ্ধমন্দির লাল চিং আর সাদা চিং। দুটি মন্দিরই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। গতকাল দুপুরের সেই পোড়া মূর্তিকেই ভক্তি করছিলেন কয়েকজন নারী। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তাঁরা বললেন, মন্দিরের কাছে পাশাপাশি বৌদ্ধ ও মুসলমানদের বাড়ি। সেখানে এমনভাবে আগুন দেওয়া হয়, যাতে শুধু বৌদ্ধদের বাড়িটিই জ্বলে যায়। লালচিংয়ে পাওয়া যায় কক্সবাজারের সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ এ্যাথিন রাখাইনকে। তিনি বলেন, ‘কারা হামলা করেছে, জানি না। তবে এ ঘটনায় ছাত্রলীগের এক নেতাও আটক হয়েছেন বলে শুনেছি।’ রামুর উত্তর মিঠাছড়িতে টিলার ওপরে স্থাপন করা হয়েছে ১০০ ফুট লম্বা শোয়ানো বুদ্ধমূর্তি। করুণা শ্রী ভিক্ষু এটি স্থাপন করেছেন। সেদিনের হামলার প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কংক্রিটের মূর্তিটি শাবল দিয়ে ভাঙার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা ভাঙতে পারেনি। তবে হামলার কারণে বৃহৎ আকারের মূর্তিটিতে ফাটল ধরেছে। সেখানে অতি মূল্যবান একটি ত্রিপিটক রাখা ছিল, সেটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনা নিজের চোখে দেখেন এমন বৌদ্ধ বাসিন্দা অমল বড়–য়া বলেন, শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা সাদ্দাম হোসেন, আমজাদ হোসেন, জিন বাবু, রুস্তম আলীসহ কয়েকজন মিছিল বের করেন। মিছিলটি বৌদ্ধমন্দির ঘুরে উপজেলা সদরের চৌমুহনীতে আসার পর রামু নাগরিক কমিটির নেতা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম যোগ দেন। মিছিলটি রামু বাজারের মোড়ে আসার পর সেখানে আরও লোকজন জড়ো হয়। সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মুশরাত জাহান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবী চন্দ ও থানার ওসি উপস্থিত হন। সাংসদ লুৎফর রহমান বক্তব্য শেষ করতে না-করতেই লাল চিং মন্দিরে আগুন জ্বলে ওঠে। কেন্দ্রীয় বৌদ্ধবিহারে পাওয়া গেল এলাকার বিএনপিদলীয় সাংসদ লুৎফর রহমানকে। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ফোনে তিনি রামু বাজারে এসে দেখেন, শত শত মানুষ জড়ো হয়েছে। তিনি আবদুল হক নামের এক মাওলানাকেও ডাকেন। এ সময় সেখানে খালি গলায় তিনি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার বক্তৃতা করছিলেন। কিন্তু লোকজন কারও কথা শুনছিল না। তিনি বলেন, এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত। মিছিলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেক লোক ছিলেন। জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা সাইমুম সরওয়ার বলেন, রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড মিছিল করেছে বিএনপি ও যুবদল। এর পরই আগুনের ঘটনা ঘটে। সঞ্জীব বড়–য়া নামের এক যুবক অভিযোগ করে বলেন, রামু মোড়ে যখন মিছিল চলছিল, তখন মন্দিরের পাশে কিছু বৌদ্ধ যুবক জড়ো হন। রামু থানার ওসি সেখানে এসে সবাইকে বাড়ি যেতে বলেন। তিনি বলেন, ‘কিছু হবে না, আপনারা চলে যান।’ এর পরই আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সঞ্জীব বড়–য়া অভিযোগ করেন, ঘটনার সময় পিকআপ ও কক্সলাইন পরিবহনে করে শত শত লোক রামুতে আসে। তারা গান পাউডার ও জ্বালানি তেল নিয়ে আসে। ওসি নিজেও তা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, কারা এসব গাড়ি ভাড়া দিল, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। কক্সলাইনের একটি বাস আটক করা হয়েছে। তবে কোনো পিকআপের মালিককে পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে কক্সলাইন পরিবহনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ বারী বলেন, ‘হামলার ঘটনায় আমাদের কোনো গাড়ি ব্যবহার করা হয়নি। হেলপাররা কাউকে না বলে একটি গাড়ি নিয়ে গেছে। সেই গাড়িটি বিজিবির হাতে ধরা পড়ে।’ গ্রেপ্তার, মামলা: বৌদ্ধমন্দিরে হামলার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ১৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও ১৯ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের বেশির ভাগই ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী ও মাদ্রাসাছাত্র। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ এদের আটক করে। এ ঘটনায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ এনে এ পর্যন্ত ১৪টি মামলা হয়েছে। যে তরুণের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার ছবি পাওয়া যায় বলে দাবি করা হয়, তাঁর নাম উত্তম কুমার বড়–য়া। উত্তমের নামেও মামলা করেছে রামু থানার পুলিশ। উত্তমকে পুলিশ খুঁজে পায়নি। তাঁর মা ও বোন পুলিশ হেফাজতে আছে। শনিবার রাতে হামলা করে ফিরে যাওয়ার সময় নাইক্ষ্যংছড়িতে কক্সলাইন নামের একটি পরিবহন কো¤পানির বাসসহ ৩০ জনকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরে এদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গতকাল সকালে রামু থানার ওসি এ কে নজিবুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়। ওপারে উত্তেজনা: কক্সবাজারের ঘটনায় সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকাতেও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। বিজিবির চট্টগ্রাম সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মো. জিল্লুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনা জানার পর গতকাল সকালে ঘুমধুম বিদ্যালয়ে বিজিবি ও মিয়ানমারের সীমান্তে নিয়োজিত নাসাকা বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠক হয়েছে।
ধরা ছোঁয়ার বাইরে মূল হোতারা ঃ
ঘটনার ৪ দিন পরও মূল হোতারা রয়েছে প্রশাসনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বরং ঘটনার মূল হোতারা এখন দগ্ধ বৌদ্ধপল্লীতে হাজির হয়ে মায়াকান্না দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্থদের পক্ষ থেকে দেয়া ঘটনায় জড়িতদের নামের তালিকার ভিত্তিতে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং ঘটনায় জড়িত নেই এমন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পুলিশ গণগ্রেফতার অভিযানে নেমেছে বলে জানিয়েছে বড়–য়া সম্প্রদায়ের নেতারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৌদ্ধদের একাধিক নেতা জানান, চার দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত মূল হোতাদের কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি। অথচ ঘটনাটি কাদের উস্কানিতে হয়েছে তা পরিস্কার। শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় চৌমুহনী চত্তর, ফকিরা বাজার, মন্ডলপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় কারা কোরআন অবমাননাকারীর শাস্তির দাবীতে উস্কানিমূলক মিছিল করেছে, তা সবাই দেখেছে। পুলিশের সামনেই সেই মিছিল হয়েছে। বরং পুলিশ মিছিলকারীদের নিরাপত্তা দিয়েছিল। জঙ্গি মিছিলের মাধ্যমে উস্কানিদাতাদের কেউ গ্রেফতার হচ্ছে না জানিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা বলেন, ঘটনাটিকে এখন রাজনৈতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঘটনায় আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী সরাসরি জড়িত। কিন্তু তারা কেউ গ্রেফতার হচ্ছে না। যারা রাতে মন্দির ও বাড়ীতে আগুন দিয়েছে তাদের অনেকেই এখন বড়–য়াদের জন্য মায়াকান্না করছে বলেও অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্থদের। তারা আরো বলেন, পুলিশের সামনেই ২০/৩০টি মটর সাইকেলে করে কিছু যুবক এসেছে। তারা গান পাউডার, পেট্রোল, কেরোসিন ইত্যাদি সরবরাহ করেছে। কিন্তু পুলিশ ও সরকারের গোয়েন্দারা তাদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্ন তুলে ক্ষতিগ্রস্থরা বলেন, সর্ষের মধ্যে ভূত রেখে আসল রহস্য বের করা যায়না। সূত্রে জানা গেছে, শনিবার রাতের ঘটনার সাথে জড়িত এমন সন্দেহভাজন ৩০ থেকে ৪০ জনের নাম পেয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনী। তাদের শনিবার রাতের ভূমিকা এবং গত এক সপ্তাহের কর্মকান্ড পর্যালোচনা করলে আসল রহস্য বের হয়ে পড়বে। তাদের মোবাইল ফোনের কল লিস্ট পরীক্ষা করলেও তারা কাকে কিভাবে এই সহিংসতায় ব্যবহার করেছে তা বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন সচেতন লোকজন।
Leave a Reply