ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার থেকে : কক্সবাজার সাগর উপকূলের টেকনাফ থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকায় ১৫টির বেশি জলদস্যু বাহিনীর রাজত্ব চলছে। গত সাত দিনে দস্যুরা অন্তত অর্ধশতাধিক মাছ ধরার ট্রলার জিম্মি করে কোটি টাকার মাছ, জাল, জ্বালানি তেলসহ মালামাল লুট করে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। দস্যুরা দ্রুতগতির স্পিডবোট ব্যবহার করায় জেলেরা বেকায়দায় পড়ছেন। অনেকে দস্যুদের ভয়ে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন।
কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সভাপতি এর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, দস্যুদের অপতৎপরতা বন্ধ করা না হলে আসন্ন রমজানে উপকূলে মাছের তীব্র সংকট দেখা দেবে। বেকার হয়ে পড়বেন জেলার প্রায় সাত হাজার ট্রলারের দেড় লাখের বেশি জেলে শ্রমিক।
কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল গ্রামের ব্যবসায়ী আবদুস সোবহান (৫৫) বলেন, গত শনিবার রাত ৮টার দিকে তার মালিকানাধীন একটি ট্রলার সাগর থেকে মাছ ধরে শহরের বাকখালী নদীর ফিশারিঘাটে ফিরছিল। ট্রলারটি সোনাদিয়া সাগর চ্যানেলে পৌঁছালে অস্ত্রধারী সাত দস্যু একটি সাদা রঙের স্পিডবোট নিয়ে ধাওয়া করে ট্রলারটি থামায় এবং ট্রলারের ১৯ জেলেকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে প্রায় দুই লাখ টাকার আহরিত মাছ ও জাল লুট করে। প্রত্যক্ষদর্শী জেলেরা জানান, একই রাতে সোনাদিয়া ও পাশের কোহেলিয়া নদী-চ্যানেলে দস্যুদের কবলে পড়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও মহেশখালীর আরও দুটি ট্রলার।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রণজিৎ কুমার বড়-য়া বলেন, ‘স্পিডবোট নিয়ে ডাকাতির খবর শুনছি; কিন্তু কারা এই বোট সরবরাহ দিচ্ছে ধরা যাচ্ছে না।’ গত সোমবার দস্যুদের প্রহারে নিহত এক জেলের লাশ সাগর উপকূলে ভাসতে দেখেছেন জেলেরা। পরে এই লাশ চট্টগ্রাম নিয়ে গেছেন জেলেরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুতুবদিয়ার দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নের দস্যুসম্রাট বাদল, তাবলেরচর এলাকার বাবুল, লেমশিখালী এলাকার রুহুল কাদের ও মজিদ, বাঁশখালীর কুতুবখালীর আবদুল হাকিম, পুঁইছড়ির জাকের হোসেন ও বাইশ্যা, ছনুয়া এলাকার গফুর, পেকুয়ার পশ্চিম টৈটং গ্রামের শুক্কুর, মহেশখালীর সোনাদিয়ার জাদু ও ফরিদ, কালারমারছড়ার খলিল ও নেছার, ধলঘাটার জসু ও কালাবাশি, টেকনাফের ধলু হোসেনসহ ১৫টির বেশি বাহিনীর চার শতাধিক সদস্য মহেশখালী, কক্সবাজার, উখিয়া, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনস সাগর উপকূলে লুটতরাজ চালাচ্ছে। কুতুবদিয়া বড়ঘোপ গ্রামের এফবি সোনারতরী ট্রলারের মাঝি (সেরাং) শফিউল আলম বলেন, ১১ জুলাই রাতে সাগরে কইলারদার নামক স্থানে দস্যুরা একসঙ্গে ১০টি ট্রলারে লুটপাত চালায়। এ সময় দস্যুরা কয়েকটি ট্রলারের মাছ, জাল, ইঞ্জিনসহ প্রায় ২০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে।
মহেশখালী ও খুরুশকুলের জেলে ছালেহ আহমদ ও রহিম উল্লাহ বলেন, ইদানীং সন্ধ্যার পর সোনাদিয়া, মহেশখালী, নাজিরারটেক, লাবণী পয়েন্টে কিছু স্পিডবোট নিয়ে দস্যুরা মাছ ধরে ফিরে আসা ট্রলারে লুটপাট চালাচ্ছে। জেলা ফিশিংবোট মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, মহেশখালী থেকে কক্সবাজার শহরে (নৌপথে) যাত্রী পারাপার করছে অর্ধশতাধিক স্পিডবোট। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব স্পিডবোট চলাচলের নিয়ম থাকলেও বেশ কিছু স্পিডবোট রাতের অন্ধকারে সাগরে গিয়ে ডাকাতিতে লিপ্ত হচ্ছে। ৮ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত ৭ দিনে জেলার বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫০টি ট্রলারে লুটপাট চালিয়েছে দস্যুরা। মহেশখালী-কক্সবাজার স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি সালাহ উদ্দিন সিকদার বলেন, ‘স্পিডবোট নিয়ে সাগরে দস্যুরা লুটপাট চালাচ্ছে সত্যি, কিন্তু ওই স্পিডবোট আমরা সরবরাহ করছি না। টেকনাফ, কক্সবাজার সৈকত, কুতুবদিয়া সমুদ্র চ্যানেলে চলাচলকারী স্পিডবোটগুলো দস্যুরা লুটপাতে ব্যবহার করছে বলে জানতে পেরেছি।’ কুতুবদিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসেম বলেন, সাগরে ডাকাতি হলে পুলিশের করার কিছু থাকে না। কারণ, এই উত্তাল সাগরে নেমে দস্যুদের প্রতিরোধ করার মতো আধুনিক জলযান পুলিশের নেই। তিনি কুতুবদিয়া সাগরে দস্যু কর্তৃক স্পিডবোট ব্যবহারের খবর সত্যি নয় বলে দাবি করেন।
Leave a Reply