এম এম হাবিবুর রহমান
ইতিকাফ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনো স্থানে আটকে পড়া বা থেমে যাওয়া। শরিয়তের পরিভাষায়, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুনিয়ার সংশ্রব, বন্ধন, সম্বন্ধ ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদে (মহিলাদের জন্য ঘরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে) অবস্থান করে ইবাদত করাকে ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ যেকোনো সময় করা যায়। রমজান মাসের শেষ ১০ দিন সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। যিনি ইতিকাফ করেন,তাকে মু’তাকিফ বলে।
ইতিকাফের গুরুত্ব : ইসলাম সামাজিকতার ধর্ম। ইসলাম বৈরাগ্যের ধর্ম নয় এবং বৈরাগ্যবাদ সমর্থন করে না। তাই আল্লাহর ইবাদতের জন্য অন্যান্য জাতির সাধক, সন্ন্যাসীদের মতো লোকালয় পরিত্যাগ করতে বলা হয়নি। বরং লোকালয়ে ইবাদত কেন্দ্র মসজিদে অবস্থানের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা মসজিদের নির্দিষ্ট স্থানগুলোয় অবস্থান করো, যখন ইতিকাফে থাক তখন স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো না। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা।’ (সূরা বাকারা-১৮৭)। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূল সা: প্রতি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেন। (বুখারি-মুসলিম)। হজরত আয়েশা রা: বলেন, রাসূল সা: প্রতি বছর রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত তিনি এ নিয়ম পালন করেন। তার ইন্তিকালের পর তার স্ত্রীরা এ নিয়ম জারি রাখেন। (বুখারি)।
ইতিকাফের প্রকারভেদ : ইতিকাফ তিন প্রকার, যথাÑ ১. ওয়াজিব ইতিকাফ। মান্নতের ইতিকাফ ওয়াজিব, তা পূর্ণ করতেই হবে। হজরত ওমর রা: এক দিন রাসূল সা:-কে বলেন, ‘হে রাসূল! জাহেলি যুগে আমি হারাম শরিফে এক রাত ইতিকাফ করার মান্নত করেছিলাম। রাসূল সা: বলেন, তুমি মান্নত পূরণ করো। (বুখারি)। ২. সুন্নাত ইতিকাফ। রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। ৩. মুস্তাহাব ইতিকাফ। রমজানের শেষ ১০ দিন ছাড়া অন্য যেকোনো সময় ইতিকাফ মুস্তাহাব।
ইতিকাফের শর্তগুলো : হ মুসলমান হওয়া। হ ইতিকাফের জন্য নিয়ত করা। হ পুরুষদের জন্য মসজিদে ছাড়া ইতিকাফ হবে না। হ শরীর পাক-পবিত্র হতে হবে। হ রোজাদার হতে হবে। হ জ্ঞানসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। হ আবশ্যকীয় প্রয়োজন ছাড়া মসজিদে অবস্থান করতে হবে।
ইতিকাফে করণীয়গুলো : ইতিকাফে করণীয়গুলো হলোÑ হ বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা। হ তাসবিহ-তাহলিল জিকির-আজকার করা। হ বেশি করে দরুদ ও ইস্তিগফার পড়া। হ তাফসির অধ্যয়ন ও হাদিসের জ্ঞানচর্চা করা। হ বেশি করে নফল নামাজ পড়া বিশেষ করে তাহিয়্যাতুল ওজু, সালাতুল এশরাক, সালাতুল চাশত, সালাতুল জাওয়াশ, সালাতুল হাজত, সালাতুল আওয়াবিন ও সালাতুল তাসবিহ প্রভৃতি নিয়মিত আদায় করা। হ দ্বীন সম্পর্কে পড়াশোনা করা ও করানো। হ ওয়াজ ও দ্বীনের প্রচার এবং প্রসারের কাজে লিপ্ত থাকা। হ ইসলাম ও ইসলামি আন্দোলন সম্পর্কে বইপত্র পড়া ও রচনা করা। হ মসজিদে থেকে করা যায় এমন সব কাজই ইতিকাফ অবস্থায় করা যায়।
ইতিকাফে বর্জনীয়গুলো : হ নিরর্থক, অপ্রয়োজনীয়, অশ্লীল কথা বলা ও কাজ করা। হ দুনিয়াবি কোনো কাজ করা। হ একবারে চুপচাপ বসে থাকা। হ অন্যের গিবত করা। হ লেনদেন বা বেচাকেনা করা। হ বসে বসে বাজে গল্প বলা বা শোনা ইত্যাদি।
যে কারণে ইতিকাফ নষ্ট হয় : হ মসজিদ বা নারীদের ইতিকাফ স্থান থেকে বিনাপ্রয়োজনে বের হলে। হ ইসলাম ত্যাগ করলে। হ অজ্ঞান, পাগল বা মাতাল হলে। হ নিয়মিত ঋতুস্রাব দেখা দিলে। হ সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে বা গর্ভপাত হলে। হ সহবাস করলে। হ বীর্যপাত ঘটলে কিন্তু স্বপ্নদোষ হলে হবে না। হ ইতিকাফকারীকে জোরপূর্বক মসজিদ বা ইতিকাফের স্থান থেকে বের করে দিলে। হ শরিয়ত অনুমোদিত কোনো কাজে বাইরে গেলে যদি কেউ আটকে রাখে বা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে ফলে ইতিকাফ স্থানে যেতে দেরি হয় তবে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
যেসব কারণে বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে : হ যেকোনো প্রাকৃতিক বা শরিয়তের প্রয়োজনে বাইরে যাওয়া যায়। হ জুমার নামাজ পড়ার ব্যবস্থা না থাকলে জুমা পড়ার জন্য নিকটবর্তী জুমা মসজিদে যাওয়া যায়, তবে এ ব্যাপারে সময়ের আন্দাজ করা ইতিকাফকারীর ওপর নির্ভর করে। হ প্রসাব, পায়খানা ও অজু করার জন্য বাইরে যাওয়া যাবে। হ খানা আনার লোক না থাকলে বাড়ি থেকে খানা এনে মসজিদে খাওয়া যাবে। হ আজান দেয়ার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যাবে। হ ঘুমানো ও আরাম করা যাবে। হ ফরজ গোসলের জন্য বাইরে যাওয়া। হ কোনো কারণে মসজিদ ভেঙে পড়লে বা আগুন লাগলে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করা। হ ইতিকাফের নিয়ত করার সময় যদি নিয়ত করে থাকে আপনজনের মৃত্যু হলে জানাজায় অংশ নেবে তবেই কেবল অংশ নিতে পারবে, অন্যথায় জানাজায় অংশ নিতে পারবে না। হ নিয়মিত সাধারণ গোসল না করা ভালো, তবে ইমামদের মতে ইতিকাফকারী যদি অস্বস্তিবোধ করে, তবে করতে পারে। হ কেবল ওয়াজিব ইতিকাফের সময় রোজাদার হতে হয় আর সুন্নাত ইতিকাফ তো রমজানেই হয়ে থাকে। হ সর্বদা ইতিকাফের হক ও মসজিদের আদবের প্রতি তীè দৃষ্টি রাখতে হবে।
অতএব, আল্লাহতায়ালার কাছে সবার চাওয়া এটিই হোক, অন্তত শেষ ১০ দিন যেন ইতিকাফের মধ্য দিয়ে রমজান মাস অতিবাহিত করতে পারি; যাতে রমজান মাস আমাদের মধ্যে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের যে সাওগত নিয়ে আগমন করেছে, তা অর্জন করতে পারি। তবে ইতিহাফের বড় উদ্দেশ্য হলো শবেকদরের ফজিলত লাভ করতে পারা।
লেখক : প্রবন্ধকার ও খতিব
Leave a Reply